মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য বিভীষিকাময় ঘটনার চিত্র ‘নিষিদ্ধ লোবান’

নোয়াখালী বন্ধুসভার পাঠচক্র
ছবি: বন্ধুসভা

দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যতবার পড়ি না কেন, তা আমাদের হৃদয়ে নতুনভাবে উপলব্ধি হয়। নারী, পুরুষ, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে যে একাত্মতা ও সাহসিকতার পরিচয় পেয়েছি, তা অতুলনীয় ও কালজয়ী। মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যুগে যুগে অসংখ্য গল্প, কবিতা, উপন্যাস, বীরত্বগাথা রচিত হয়েছে। কিন্তু ওই সময়কার বর্বরতা, হত্যা ও অত্যাচারের সেই বিভীষিকাময় ইতিহাস আমরা কতটুকু হৃদয়ে ধারণ করতে পেরেছি?

তাই ৮ সেপ্টেম্বর নোয়াখালী বন্ধুসভার চলতি মাসের প্রথম এবং বছরের ২০তম পাঠচক্র ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস নিয়ে। নির্ধারিত বই ছিল প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ‘নিষিদ্ধ লোবান’। মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকা হয়তো আমরা দেখিনি, কিন্তু ‘নিষিদ্ধ লোবান’ এমন একটি উপন্যাস, তা যেন হাজারো বিভীষিকাময় ঘটনার চিত্র তুলে ধরে মানসপটে।

ঘটনার শুরু বিলকিস নামের এক নারীর ট্রেনযাত্রার মধ্য দিয়ে। স্বামী নিখোঁজ হওয়া এই নারী জানে না আদৌ তার স্বামীর দেখা পাবে কি না। লোকটি বেঁচে আছে কি মারা গেছে, তা–ও জানে না সে। তার ট্রেনযাত্রার গন্তব্য ছিল জলেশ্বরী, যেখানে রয়েছে তার মা, ভাই ও বোন। কিন্তু নবগ্রাম স্টেশনে এসে ট্রেন থেমে যায়। কারণ, জলেশ্বরীতে যাওয়ার রেলপথ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়; এবং জানতে পারে ২৫ মার্চের কালরাতের পর যখন হানাদার বাহিনী সারা বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে হত্যা, ধর্ষণ ও লুট চালায়, সে রকম এক ঘটনার সাক্ষী হয় তার গ্রাম জলেশ্বরীও। অজানা আশঙ্কায় বাকি পথ হেঁটে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় এই নারী এবং তার সঙ্গী হয় ১৭-১৮ বছরের কিশোর সিরাজ।

জলেশ্বরীতে পৌঁছে মুখোমুখি হয় করুণ ও ভয়াবহ বর্বরতার। জানতে পারে, তার ভাইসহ গ্রামের অসংখ্য মানুষকে বাজারে লাইন ধরে হত্যা করে ফেলে রাখা হয় শিয়াল–শকুনদের খাদ্য হওয়ার জন্য। লাশ ছোঁয়ার অনুমতি নেই কারও। বিলকিস সিদ্ধান্ত নেয় তার ভাইকে কবর দেবে। কিন্তু যখন বাজারে সারি সারি লাশ দেখে তার চেতনা থমকে দাঁড়ায়। বিলকিসের সঙ্গী সিরাজের তখন মনে হয় ঘুমন্ত অনেক মানুষ, আর তার মধ্য দিয়ে প্রেতের মতো হেঁটে চলছে এক রমণী; যাকে বর্তমানের মনে হয় না, অতীতের কিংবা ভবিষ্যতেরও নয়।

লাশের সারিতে ভাইকে খুঁজতে গিয়ে সিদ্ধান্ত পাল্টায় যে সবাইকে কবর দেবে সে। এরই ঘটনাপ্রবাহে জানতে পারে মুসলিম নামধারী সিরাজ আসলে হিন্দুধর্মাবলম্বী প্রদীপ, যে কিনা সর্বস্ব হারিয়ে ফেলার পরও দেশ ত্যাগ করেনি; কাজ করছে মুক্তিবাহিনীর হয়ে। শেষ পর্যন্ত তারা ধরে পড়ে যায় এবং বরণ করে করুণ পরিণতি। এমন হাজারো সিরাজ কিংবা বিলকিসের ঘটনার সাক্ষী আমাদের মুক্তিযুদ্ধ।

গল্পের শেষে বন্ধুরা একে একে তাঁদের মন্তব্য ব্যক্ত করে বইটি নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা করেন। মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক আফরিনা আনিকা ‘নিষিদ্ধ লোবান’ নামটির অর্থ ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘লোবান মানে সুগন্ধি; আর বইতে লাশের গন্ধকে লেখক নিষিদ্ধ লোবান বলে আখ্যা দেন। সবার অন্তত জীবনে একবার হলেও বইটি পড়া উচিত। এ গল্পের মাধ্যমে আমরা মুক্তিযুদ্ধকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারব।’

যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জ্যানিসা আফরোজের সঞ্চালনায় এবং গল্পের কিছু দিক ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে পাঠচক্রের সমাপ্তি হয়। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সহসভাপতি জাহিদ হাসান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ হোসেন, অর্থ সম্পাদক উম্মে ফারহিন, পাঠচক্র ও পাঠাগার সম্পাদক তাজকির হোসেন, দুর্যোগ ও ত্রাণ সম্পাদক মো. শিমুল, স্বাস্থ্য ও ক্রীড়া সম্পাদক প্রণয় মজুমদারসহ অন্য বন্ধুরা।

যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, নোয়াখালী বন্ধুসভা