মনের কোণে একটি ফুলের বাগান তৈরি করা প্রয়োজন

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের সভাকক্ষে ‘চাপমুক্ত জীবন রিলাক্সেশন স্কিলস’ কর্মশালায় আলোচনা করছেন সাইকোথেরাপিস্ট ও কনসালট্যান্ট মাহমুদা মুহসিনা
ছবি: বন্ধুসভা

বন্ধুরা চোখ বন্ধ করে আছেন। তাঁদের বলা হলো, নিজেকে নিয়ে ভাবতে এবং মনের ভেতর একটি সুরক্ষিত স্থান তৈরি করতে। যেখানে আগে কেউ কোনো দিন যায়নি, সে জায়গা কেউ ব্যবহার করেনি, চাষাবাদও করেনি। সেখানে একটি ফুলের বাগান তৈরি করতে হবে।

বাগান তৈরির জন্য প্রথমে একটি জায়গা বেছে নিলেন সবাই। জায়গার চারপাশে বাউন্ডারি দিলেন। তারপর নিজেদের ইচ্ছেমতো ফুলের গাছ, ফলের গাছ, ঔষধি গাছসহ যাঁর যে গাছ লাগাতে ভালো লাগে, ছোট কিংবা বড়— সেগুলো বাগানে লাগালেন। গাছ লাগানো শেষে বাগানের পাশে একটি ছোট্ট পুকুর তৈরি করলেন। পুকুরের পাশে একটি বেঞ্চ তৈরি করলেন, যেখানে বসে নিজের জন্য সময় কাটাতে পারেন। আরও বলা হলো, যদি কোনো পছন্দের পশু বা পোষা প্রাণী থাকে, সেটিকেও যেন সঙ্গে নেওয়া হয়। যদি মনে হয় পশুটি বাগান নষ্ট করবে, তাহলে তাকে সেখানে নেওয়া যাবে না।

চাইলে পছন্দের কোনো মানুষকেও নিয়ে যেতে বলা হয়, যাঁর সঙ্গে সব ভালো স্মৃতি, কোনো খারাপ স্মৃতি নেই। সেই মানুষটিকে বাগানের বেঞ্চে বসার জায়গা দিলেন কেউ কেউ। যাঁদের এমন মানুষ নেই, তাঁরা একাই বসলেন। যাঁর সঙ্গে একটুও খারাপ সম্পর্ক আছে বা কখনো খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেই সব ব্যক্তিকে সেখানে স্থান দিতে নিষেধ করা হলো। প্রয়োজনে নিজেকে একা রাখা ভালো।

এভাবে চাইলে যে কেউ প্রতিদিন নিজের জন্য কিছু সময় রেখে মেডিটেশন করতে পারেন। প্রত্যেক মানুষেরই ভালো থাকার জন্য নিজের মনের কোণে একটি ফুলের বাগান তৈরি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ঢাকা সিটি হাসপাতাল লিমিটেডের সাইকোথেরাপিস্ট ও কনসালট্যান্ট মাহমুদা মুহসিনা। প্রথম আলো বন্ধুসভার ‘চাপমুক্ত জীবন রিলাক্সেশন স্কিলস’ কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের এভাবেই এক কল্পনার জগতে নিয়ে যান তিনি। সবাই এতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন।

‘চাপমুক্ত জীবন রিলাক্সেশন স্কিলস’ কর্মশালা
ছবি: অনিক সরকার

২২ আগস্ট রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের সভাকক্ষে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক এ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার সহযোগিতায় বেলা তিনটায় শুরু হয়ে সেশন চলে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত। অংশ নেন ঢাকার বিভিন্ন বন্ধুসভার বন্ধুরা।

পরিচয় পর্বের পর সাইকোথেরাপিস্ট মাহমুদা মুহসিনা সবার কাছে জানতে চান—নিজেকে নিয়ে তাঁদের উপলব্ধি কী, নিজেদের কিসের সঙ্গে তুলনা করতে চান? জবাবে বন্ধু আনিকা তাসনিম বলেন, ‘শান্ত পাহাড়ের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করি।’ তানভীর হাসান বলেন, ‘নিজেকে খরস্রোতা নদীর সঙ্গে তুলনা করি। নদীর মতোই জীবন কখনো উত্তাল, কখনো নীরব।’ মেঘা খেতান নিজেকে মেঘের সঙ্গে তুলনা করেন। আবার কেউ কেউ নিজেকে গাছ, ফুল, প্রকৃতি, পাখি, পানি ও বইয়ের সঙ্গে তুলনা করেন। বন্ধু ডা. কাভী সিকান্দার নিজেকে অপ্রদর্শিত অভিনেতার সঙ্গে তুলনা করে বলেন, ‘জীবনের এই নাট্যমঞ্চে অভিনয় করতে এসেছি এবং অভিনয় করে চলেছি।’ বন্ধু তাসনিম খান নিজেকে ফিনিক্স পাখির সঙ্গে তুলনা করে বলেন, ‘ফিনিক্স পাখি যেমন ছাই হয়ে নতুন করে জন্ম নেয়, আমিও জীবনের প্রতিটি আঘাত থেকে উঠে দাঁড়াই এবং নতুন করে পথচলা শুরু করি।’

রিলাক্সেশন সেশনে প্রশিক্ষক মাহমুদা মুহসিনা মনোবিজ্ঞানী কার্ল রজার্সের ‘রিয়েল সেলফ’ ও ‘আইডিয়াল সেলফ’-এর তত্ত্ব তুলে ধরে বলেন, ‘আমাদের বাস্তব সত্তা হলো বর্তমানে যেমন আছি, আর আদর্শ সত্তা হলো আমরা যেমন হতে চাই। জীবনের মানচিত্র যেমন আঁকাবাঁকা পথে ভরা, তেমনি আমাদের জীবনের সত্তাও নানা চিন্তা, স্মৃতি, স্বপ্ন ও কল্পনায় তৈরি।’

পর্যায়ক্রমে চাপমুক্ত রিলাক্সেশন জীবনবিষয়ক আরও কিছু সেশন করা হয়। প্রতিটি সেশন শেষে অংশগ্রহণকারীদের মতামত এবং তাঁরা কী উপলব্ধি করেছেন, সে বিষয়ে জানতে চান প্রশিক্ষক। অনেকেই গভীর আত্ম-অনুভূতিতে কান্নায় ভেঙে পড়েন, দুঃখ প্রকাশ করে সবার সামনে নির্বিবাদে নিজের ভেতরের কষ্ট উজাড় করে দেন।

কর্মশালা শেষে বন্ধুরা
ছবি: অনিক সরকার

জীবনের গল্প শেয়ার করেন বন্ধু নাদিয়া রহমান ও মোহাম্মদ ইসমাইল। গল্প বলার সময় তাঁরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। পুরো সভাকক্ষ নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কান্নার শব্দে পরিবেশ আরও ভারী হয়ে ওঠে।

সেশন শেষে কেউ কেউ অনুভূতি জানান। বন্ধু নাবিবা রহমান বলেন, ‘আজকের এই সেশনে না এলে হয়তো কখনোই জানতাম না যে “আমি” অস্তিত্বশীল। নিজেকে নিয়ে কখনোই ভাবিনি এমনভাবে। আজ নিজের সত্তাকে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারছি।’

সমাপনী বক্তব্যে ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার সাংগঠনিক সম্পাদক অনিক সরকার বলেন, ‘প্রতিটি সেশন আমাদের ভেতরের লুকানো দুঃখ কিংবা হাসিকে বাইরে নিয়ে আসে। আজ যাঁরা এসেছেন, আশা সবাই অনেক কিছু নিয়ে যাচ্ছেন।’