‘আব্বুকে ছাড়া আমি এখনো অচল’

রাজবাড়ীতে ‘কথা হোক: বাবা-মেয়ের গল্প শুনি’ আয়োজনছবি: প্রথম আলো

এখনো আমার ইন্টারনেট প্যাক আব্বু কিনে দেন। সাংস্কৃতিক চর্চার পুরোটাই পেয়েছি আব্বুর কাছ থেকে। রাজবাড়ীতে ‘কথা হোক: বাবা-মেয়ের গল্প শুনি’ অনুষ্ঠানে এসে এ কথা বলেন চিকিৎসক তানজিলা খান রিম্পি। প্রথম আলোর আমন্ত্রণে ১০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আসেন বাবা সমশের আলী খান ও মেয়ে তানজিলা খান রিম্পি।

সমশের আলী খান কৃষি ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত পরিদর্শক ও তানজিলা খান রিম্পি রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা। প্রথম আলো ডটকমের সহযোগিতায় জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) সেলিব্রেটিং ডটার্স ক্যাম্পেইনের আওতায় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শুরুতেই অতিথিদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। শুভেচ্ছা জানান শিক্ষার্থী সামিয়া মাসুদ, অর্দ্রিজা চক্রবর্তী ও সপ্তদীপা পাল।

তানজিলা খান বলেন, ‘আমাদের দেশে সাধারণত বাবার সঙ্গে মেয়ের সম্পর্ক অন্য রকম হয়। আর ছেলের সঙ্গে মায়ের। আমরা পাঁচ বোন, ভাই নেই। আমরা কীভাবে এত দূর এলাম। বেশির ভাগই আব্বু করেছে।’

তানজিলা আরও বলেন, ‘আমাদের পড়ালেখার বিষয়ে বাবা কখনোই নাক গলায়নি। কখনো বলেনি এই রেজাল্ট কেন হলো। ওই রেজাল্ট কেন হলো। এখনো আমার মনে আছে। আমি ক্লাস এইটের একটি পরীক্ষা দিতে পারিনি। সেবার আমি সপ্তম হয়েছিলাম। বাবা আমাকে একটি ঘড়ি গিফট করেন। বললেন, একটি পরীক্ষা দিস নাই এ জন্য ঘড়ি। পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে, রেজাল্ট ভালো করতে হবে, এমন কিছু চাপিয়ে দিত না। আমাদের সময় সুযোগ-সুবিধা কম ছিল। কিন্তু আমার অদম্য ইচ্ছাশক্তি ছিল। ইচ্ছাশক্তি ছিল খুব ভয়ংকর। আমি প্রথমবার মেডিকেলে চান্স পাইনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। পরেরবার মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। আবার মেডিকেলেও পরীক্ষার আগে মনে হতো মরে যাই। কিন্তু চালিয়ে গেছি।’

তানজিলা খান বলেন, ‘আব্বু বাসায় আলাদাভাবে প্রাইভেট পড়াতেন। অনেক স্টুডেন্ট ছিল। আব্বু আমার পড়ালেখা নিয়ে কিছুই জিজ্ঞাসা করতেন না। কিন্তু যেদিন বলতেন, তোর অঙ্ক বই নিয়ে আয়। সেদিন আমার কেয়ামত হয়ে যেত। দুই কান দিয়ে ভাপ বের হতো। আব্বু প্রচণ্ড রাগী ছিল। আব্বুর রাগ থেকে আমার মা বাঁচাতেন। আব্বুর কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইতাম। তবে আব্বু সাধারণত পড়াত না। আমাদের এটা হতে হবে, এটা হও। এসব চাপিয়ে দিত না। আমরা পাঁচ বোন বিজ্ঞান বিভাগে পড়েছি। অনেক প্রাইভেট পড়তে হতো। অনেক দিন প্রাইভেট পড়ে বাসায় যাইনি। বাসা বেশ দূরে ছিল। বান্ধবীর বাসায় থেকে পরদিন পড়ে বাড়ি গিয়েছি।

‘আমি কৃষকের সন্তান। চেয়েছি আমার মেয়েরা ভালোভাবে পড়ালেখা করুক।’
সমশের আলী খান

‘আমাদের অবাধ স্বাধীনতা ছিল। জন্মদিন, বান্ধবীর বাসায় দাওয়াত খাওয়া, টেলিভিশনে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলা দেখায় বাধা দিত না। আমাদের বাড়িতে রঙিন টেলিভিশন ছিল। প্রথম আলোর আগে আমাদের বাসায় ভোরের কাগজ রাখা হতো। ইষ্টিকুটুম নামে একটি পাতা ছিল। সেই সময় পত্রিকা পড়তাম। বাসায় বিচিত্রা, মদিনা, পূজার সংখ্যা প্রভৃতি রাখা হতো। বাবার কাছ থেকেই আমাদের প্রতিদিন পত্রিকা পড়ার অভ্যাস হয়। সাংস্কৃতিক চর্চা পুরোটাই আব্বুর কাছ থেকে পাওয়া।

‘এখনো আব্বু আমার বেতনের বিল সাবমিট করে দেয়। আয়কর জমা দেয়। আমি কিছু করি না। আমি ইন্টারনেট প্যাক কিনতে পারি। কিন্তু বাবাকে দিয়ে কেনাই। বাবা বলেন, ইন্টারনেটও কিনতে পারিস না! আব্বু আগে খুব রাগী ছিল। এখন খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। আমি আব্বুর চেয়ে ভালো অবস্থানে আছি। কিন্তু কোনোভাবেই আব্বুকে অতিক্রম করা সম্ভব নয়। কারণ, আব্বুকে ছাড়া আমি এখনো অচল।

‘আব্বুকে কতটুকু ভালোবাসি, সেটা কয়েক দিন আগে বুঝতে পেরেছি। আব্বু কয়েক দিন আগে হাসপাতালে এসে প্রেশার মাপাচ্ছিলেন। আমি জরুরি বিভাগে ডিউটিতে ছিলাম। একপর্যায়ে তাকিয়ে দেখি আব্বু প্রেশার মাপাচ্ছেন। আব্বু এক সাইডে বোধশক্তি পাচ্ছিলেন না। তখন আব্বুকে একজনকে দিয়ে ক্লিনিকে পাঠিয়ে দিই। আমি আরও তিন ঘণ্টা রোগী দেখি। অনেক বাবাকে চিকিৎসা দিই। কিন্তু নিজের বাবাকে সেবা দিতে পারিনি।’

সমশের আলী খান বলেন, ‘আমি কৃষকের সন্তান। চেয়েছি আমার মেয়েরা ভালোভাবে পড়ালেখা করুক। আমার পাঁচ মেয়েই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছে। কেউ এক বছর, দুই বছরও পড়েছে। চেয়েছি ভালোভাবে পড়ালেখা করতে হবে, সেটা যেখানেই হোক।’

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সাবেক শিক্ষক মো. আবদুল হামিদ, নাগরিক কমিটির সহসভাপতি আবদুস সামাদ মিয়া, বন্ধুসভার সভাপতি আরিফুর রহমান। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো রাজবাড়ী প্রতিনিধি এজাজ আহম্মেদ।

সবশেষে ‘আয় খুকু আয়....’ গান দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করা হয়। গান পরিবেশন করেন অমিতা চক্রবর্তী, আবদুল জব্বার ও কানিজ ফাতেমা।