একাত্তরের গল্প শুনল কিশোর শিক্ষার্থীরা

গাজীপুর বন্ধুসভার আয়োজনে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প শুনি’ অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে গল্প শুনছে শিক্ষার্থীরাছবি: বন্ধুসভা

গাজীপুরে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছিল শক্ত অবস্থান। জেলার বিভিন্ন স্থানে সেনারা নির্বিচার গণহত্যা চালায়। সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা চালায় ভাওয়াল রাজবাড়ী এলাকায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্মরণীয় নানা গল্প শোনাতে গিয়ে এসব তথ্য জানান গাজীপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার মো. হাতেম আলী। এ সময় তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের কোনো বিশেষ দিন চাই না। মুক্তিযুদ্ধ সারা বছরই আমাদের চেতনায় থাকা উচিত। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভালো জানতে হবে।’

২১ মার্চ সকালে গাজীপুর মহানগরের বাঙ্গালগাছ এলাকার পাথফাইন্ডার সেন্ট্রাল স্কুল মাঠে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প শুনি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে গাজীপুর বন্ধুসভা। এতে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। আজমাইন মাহতাবের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. হাতেম আলী ও সিরাজুল ইসলাম।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পাথফাইন্ডার সেন্ট্রাল স্কুলের বাংলা বিভাগের শিক্ষক উম্মে সালমা, শিক্ষক আবেদা সুলতানা, গাজীপুর বন্ধুসভার সভাপতি নাঈমা সুলতানা, কার্যনির্বাহী সদস্য ইমরান আকন্দ, সাংগঠনিক সম্পাদক উম্মে কুলসুম, সাগর ইসলাম, তামান্না তাবাসসুম, অলি আহমেদ, মিনারা মিনা, আশিকুর আশিক, ইমরান খান, মাহবুব মণ্ডল, লুৎফর রহমান প্রমুখ। বন্ধুরা মুক্তিযোদ্ধাদের ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানান।

মো. হাতেম আলী জানান, তখন ভাওয়াল রাজবাড়ীতে ছিল দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান। ঢাকা নর্থের হেডকোয়ার্টার ছিল এটি। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ এ রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে এলে পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকায় হত্যাযজ্ঞ চালায়। এর জেরে ২৬ ও ২৭ মার্চ রাতে বাঙালি সেনাসহ এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা এ রেজিমেন্টের পাকিস্তানি সৈন্যদের পরিবারসহ হত্যা করেন। আইয়ুব আলী নামের এক পাকিস্তানি সুবেদার এলএমজি নিয়ে রাজবাড়ির পাশে পানির ট্যাংকের ওপরে অবস্থান নেয়। ২৮ মার্চ এই রেজিমেন্ট দখলে নিতে পাকিস্তানিরা হেলিকপ্টার ও বিমান থেকে গুলিবর্ষণ ও বোমা ফেলে। তারা আইয়ুব আলীকে হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। ২৯ মার্চ রাজবাড়ী দখলে নেয়। এদিন তারা জয়দেবপুর বাজারে দোকানপাট ও আশপাশের এলাকার বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।

হাতেম আলী আরও বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে ইন্টারমিডিয়েট পাস করা বাঙালি ছেলেদের নিয়ে ন্যাশনাল ট্রেনিং কোর শুরু হয়েছিল। তাঁদের অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল। ন্যাশনাল কোরের ছেলেরা বের হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবেন, এমন আশঙ্কায় পাকিস্তানিরা যাঁর যাঁর এলাকায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে পরিকল্পিতভাবে তাঁদের ঢাকা থেকে এই রাজবাড়ীতে নিয়ে আসে। গাজীপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল এলাকার ন্যাশনাল কোরের প্রায় এক শ ছেলেকে তারা এখানে এনে বন্দী করে রাখে। পাকিস্তানিরা গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ধরে রাজবাড়ীতে নিয়ে আসত। এখানে তারা ৯ এপ্রিল গণহত্যা চালায়। জড়ো করা ন্যাশনাল কোর বাহিনীর সদস্যসহ আনুমানিক ৩০০ জনকে হত্যা করা হয়। এর পর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই পাকিস্তানি সেনারা মানুষ হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এখানে কত মানুষকে হত্যা করা হয়, তার সঠিক হিসাব নেই। স্বাধীনতার পর ভাওয়াল রাজবাড়ী–সংলগ্ন পুকুর ও ডোবা থেকে অসংখ্য মানুষের মাথার খুলি, কঙ্কাল ও হাড় উদ্ধার করা হয়।

হাতেম আলী আরও জানান, গণহত্যার স্থানটিতে স্মৃতিস্তম্ভ করার জন্য জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে বহুবার দাবি জানানো হয়েছে। পাঁচ-সাত বছর আগে জমি নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি করা হয়েছিল। আমিও ওই কমিটির সদস্য ছিলাম।’

বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী চৈতি আক্তার বলে, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গাজীপুরের ঘটনাগুলো আমার জানা ছিল না। আজ দীর্ঘ সময় মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে অনেক কিছুই জানতে পারলাম।’

দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাসুমা আক্তার বলে, দাদুভাই (মুক্তিযোদ্ধা হাতেম আলী) আমাদের অনেক গল্প শুনিয়েছেন; যা খুবই মর্মান্তিক। গল্প শুনতে গিয়ে চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছে। আমাদের দেশের জন্য যারা যুদ্ধ করেছেন, তাঁদের জন্য আমাদের আরও অনেক কিছু করা দরকার।’