তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া চট্টগ্রামের সাইফুল ইসলামের বাবা দিনমজুর। হঠাৎই চট্টগ্রাম বন্ধুসভার বন্ধুদের কাছ থেকে নতুন জামা পেয়ে খুশিতে আটখানা হয় সাইফুল। তার মতোই খুশিতে উত্তাল বান্দরবানের তুহিন, মরিয়ম, মারুফা, আরমানসহ আরও অনেক শিশু। বন্ধুসভার কাছ থেকে নতুন জামা উপহার পেয়েছে তারাও। পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জের শিশু ফাতেমার চোখেমুখে উপচে পড়া আনন্দ দেখে কে! ‘কত্ত সুন্দর জামাডা! ম্যাডাম, আমার জামাডা বেশি সুন্দর হইছে না!’ বলে ঘুরে ঘুরে সবাইকে নতুন জামা দেখিয়ে বেড়ায় ফাতেমা। ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা তার মতো আরও প্রায় ১৫০ শিশুকে নতুন জামা উপহার দিয়েছে।
গোপালগঞ্জের স্বামীহারা বৃদ্ধ জামিলা বেগম (৫৭) রোজা রেখেই শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়ান। মানুষের কাছ থেকে পাওয়া সাহায্যেই তাঁর খাবারের জোগান হয়। কিন্তু এবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার কিনে দেওয়া ঈদবাজারে রোজার ঈদটা তাঁর কাছে আনন্দ বয়ে আনে। ‘বাবা আর ভিক্ষা করি যে ইনকাম হয়, ইয়ান দিয়েরে চলি। জিনিসপত্তর দাম বাইজ্জি বলি ঠিকমতো খানাও ন জুটে। তোয়ারার ঈদ উপহার ফাইয়েরে বউত খুশি হয়্যি।’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার কাছ থেকে খাদ্যসামগ্রী উপহার পেয়ে আবেগাপ্লুত প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক আবদুল সাত্তারও নিজের আনন্দ প্রকাশ করেন।
রাজধানীর মিরপুরের বেগুনটিলা বস্তির ভ্যানচালক ইস্রাফিল (৩৮) দুই পায়ে গ্যাংগ্রিন নিয়ে অচলপ্রায়। জাতীয় পর্ষদের পক্ষ থেকে ঈদ উপহার হিসেবে তাঁর হাতে অর্থ তুলে দেওয়া হয়। অর্থ পেয়ে ইস্রাফিলের স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘আপনাগোর দেওয়া টাকা কয়ডায় হের লেইগ্গা ওষুধ কিন্না পোলাপানগুলার জন্যও কিছু ভালো খাওন কিনুম। আল্লায় আপনাগো ভালো করুক।’
রোজার ঈদ উপলক্ষে ‘সহমর্মিতার ঈদ’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে দেশ ও দেশের বাইরের ১০৮টি বন্ধুসভা গত ৩০ মার্চ থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশব্যাপী ঈদের উপহারসামগ্রী বিতরণ করে। জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের আহ্বানে দেশের নানা প্রান্তে ঈদ উপহার প্রদানের অংশ হিসেবে শিশুদের জন্য নতুন জামা, সুবিধা বঞ্চিত পরিবারের জন্য খাদ্যসামগ্রী প্রদান, বিশেষ চাহিদায় কারও জন্য চিকিৎসা সহায়তাসহ নানাভাবে এ কর্মসূচি পালিত হয়। সারা দেশে ৩ হাজার ৪৬৬ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে নতুন জামা, ৩ হাজার ৪১০টি পরিবারকে খাদ্যসামগ্রীসহ সর্বমোট ২৪ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৮ টাকার উপহার, সহায়তা প্রদান করেন বন্ধুসভার বন্ধুরা। কয়েক বছর ধরে নিজেদের চাঁদা, উপদেষ্টা ও পরিচিতজনদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অনুদান ও বিভিন্নজনের সহায়তায় সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে সারা দেশের বন্ধুরা এ কর্মসূচি পালন করছেন। এতে বিভিন্ন স্থানে অনেকেই বড় অঙ্কের টাকা অনুদান দেন।
অতিদরিদ্র মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটাতে বন্ধুসভার এই উদ্যোগ শুধু আনন্দই নয়, দিয়েছে স্বস্তিও। এমন অনেক মানুষের কাছে বন্ধুরা উপহার পৌঁছে দিয়েছেন, তাঁদের দেওয়া উপহারটুকুই ছিল যাঁদের কাছে ঈদের দিনে খাবারের একমাত্র জোগান, আনন্দের একমাত্র উৎস।
ঈদ উপহারের পাশাপাশি বিভিন্ন বন্ধুসভার বৈচিত্র্যময় নানা আয়োজন অনেকের জন্যই এবারের ঈদটা রঙিন করে তোলে। যেমন ভৈরব বন্ধুসভা নতুন জামার সঙ্গে শিশুদের হাতে তুলে দেয় ঈদসালামির নতুন টাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর বন্ধুসভাসহ অনেক বন্ধুসভা শিশুদের জন্য আয়োজন করে মেহেদি উৎসব। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিরাজগঞ্জসহ আরও অনেক বন্ধুসভা স্থানীয় অসহায় পরিবারগুলোকে খুঁজে বের করে অর্থসহায়তা দেয়। পাবনা এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু বন্ধুসভা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে কর্মরত স্বল্প বেতনধারী আনসার, নিরাপত্তাপ্রহরীসহ বিভিন্নজনকে ঈদের বাজার করে দেয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে অসহায় ও ছিন্নমূল মানুষদের খুঁজে খুঁজে খাদ্যসামগ্রী উপহার তুলে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা দেশের নানা প্রান্তে সদস্যদের নিজেদের এলাকায় পালন করে এই কর্মসূচি। গোয়ালন্দ বন্ধুসভা বিধবা নারীদের কাছে পৌঁছে দেয় ঈদ উপহার। বগুড়া বন্ধুসভা শেরপুরের বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্রে বিতরণ করে ঈদ উপহার।
করোনার রেশ না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ঈদ। প্রতিবছর নিজেদের টাকায় সহমর্মিতার ঈদ কর্মসূচি পালন করলেও এবার অনেকেই এই কর্মসূচি পালনে অপারগ হন। এমন বন্ধুসভাগুলোর জন্য নিজেদের উত্তোলনকৃত তহবিল থেকে জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা সহায়তা প্রদান করে; যাতে সেসব বন্ধুসভা নিজ এলাকায়, সহমর্মিতায়, অভাবী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারে। জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ নিজেদের উদ্যোগেও ঢাকায় ৪০০ শিশুকে নতুন জামা ও ৪১০টি পরিবারকে ঈদের খাদ্যসামগ্রী উপহার দেয়। পাশাপাশি বেশ কয়েকজন অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসার জন্য অর্থসহায়তা করে তারা। এ বছর সাংগঠনিক ইফতারের আয়োজন না করে আনুষ্ঠানিক ইফতারের পুরো টাকা সহমর্মিতার ঈদ কর্মসূচির জন্য ব্যয় করে জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ।
সহমর্মিতার ঈদ কার্যক্রমে সর্বোচ্চসংখ্যক পরিবার ও শিশুকে উপহার দেওয়ার পাশাপাশি কর্মকাণ্ডের বৈচিত্র্য বিবেচনায় এ বছরও ১০টি বন্ধুসভাকে কেন্দ্রীয়ভাবে সেরা ঘোষণা করা হবে। ভালো কাজে প্রতিযোগিতায় উৎসাহ দিতে পরে তাদের হাতে সনদ ও ক্রেস্ট তুলে দেওয়া হবে।
প্রথম আলো বন্ধুসভার সভাপতি উত্তম রয় ও নির্বাহী সভাপতি মৌসুমী মৌয়ের নেতৃত্বে এবং জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সার্বিক সহযোগিতায় এবারের সহমর্মিতার ঈদ কর্মসূচি সমন্বয় করেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ফাহমিনা বর্ষা। আর বিভাগীয় পর্যায়ে তাঁকে সহায়তা করেন জাতীয় পর্ষদ ও মহানগর বন্ধুসভার রেদওয়ান মাহমুদ, খায়রুন নাহার, শাফিন উজ জামান, হাসান মাহমুদ সম্রাট, মাহমুদা তমা, মেঘা খেতান, শাহিদা আলম, শারমিন আরা তৃষা, সোহানী শিফা, তৌহিদ ইমামসহ অন্য সদস্যরা।