সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করেছে সিলেট বন্ধুসভা। ২৩ মে প্রথম আলো সিলেট অফিসের বন্ধুসভা কক্ষে এটি অনুষ্ঠিত হয়। ‘সাম্যের গান গাই’ শিরোনামে অনুষ্ঠানটি বেলা তিনটায় শুরু হয়ে চলে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত।
সঞ্চালনার শুরুতে বন্ধু ফারহানা হক অমি বলেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও সংগীতজ্ঞ। তাঁর মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য, তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও প্রধান পরিচয় তিনি কবি। বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তিনি ছিলেন মানবতার কবি, সাম্যবাদী কবি, সর্বোপরি বিশ্ববেদনার কবি। তাঁর প্রায় সব রচনাই বেদনার সুরে ভরপুর। আর্ত-ব্যথিত-উৎপীড়িত মানবমনের ব্যথাকেই প্রতিটি রচনাকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন।’
দলীয় সংগীতের মাধ্যমে শুরু হয় সাংস্কৃতিক পর্ব। ধারাবাহিকভাবে একক গান পরিবেশন করেন বন্ধু দেব রায় সৌমেন, প্রীতম তালুকদার, প্রত্যাশা তালুকদার, সূবর্ণা দেব ও যুবরাজ রায়। একক কবিতা আবৃত্তি করেন বন্ধু প্রীতম তালুকদার।
সভাপতি দেব রায় সৌমেন বলেন, ‘কাব্যকার যখন ব্যক্তিগত বেদনার কথা ভুলে বিশ্ববাসীর মনে সহানুভূতির তরঙ্গ তুলতে পারেন, তাঁর রচনার ইন্দ্রজালে যখন মানুষ নিজের ব্যক্তিগত বেদনার কথা ভুলে সমগ্র বিশ্বমনের বেদনাবোধের সঙ্গে নিজ মনের যোগ সাধন করতে পারে, তখনই কাব্যকারের রচনা সফল হয়। নজরুলের কাব্যে বেদনার এই বিশ্বরূপ আছে বলেই তাঁর কাব্যকে আমরা বিশ্বসাহিত্য বলে অভিনন্দন জানাই।’
বন্ধু সমীর বৈষ্ণব বলেন, ‘উপনিবেশবিরোধী, স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রত্যাশা, সাম্যবাদী চিন্তা এবং বিংশ শতাব্দীর হিন্দু-মধ্যবিত্তের হতাশা ও নৈরাজ্যের সময় নবজাগ্রত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির চেতনা স্পর্শ করার সক্ষমতা নজরুলকে দ্রুত জনপ্রিয় করে তুলেছিল। সমকালে তাঁর কবিতা জাতির প্রাণে নবজাগরণের উদ্দীপনা আনে। তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সামাজিক অবিচার ও শোষণ-নির্যাতন-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর তৎকালীন জনমানস স্পর্শ করেছিল।’
বন্ধু ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘নজরুলের সাহিত্য যেমন বিদ্রোহ, শান্তি, সাম্যবাদ সর্বহারার সাহিত্য তেমনি বিশ্ববেদনার সাহিত্যও। তাঁর সাহিত্য সৃজনের সূচনা যেমন প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে, সমাপ্তি তেমনি তৃপ্তি-অতৃপ্তির আস্বাদনের ভেতর দিয়ে। সমকালীন শোষিত-মজলুম মানুষের পক্ষে তাঁর কলম বেদনামথিত হয়েই উচ্চকিত। সময়ের যোগ্য দায়িত্ব তিনিই কর্মী কবি হিসেবে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। এ জন্য তাঁর কবিতায় করুণরসের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ-শান্তি, স্বাধীনতা, সর্বহারা-সাম্যবাদ প্রাধান্য পেয়েছে।’
বন্ধু প্রত্যাশা তালুকদার বলেন, ‘বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি, সাম্যবাদী কবি কিংবা সর্বহারার কবি হিসেবে মহাকাল কাজী নজরুল ইসলামকে মনে রেখেছে। তবে তিনি যে বিশ্ববেদনার কবি, এটাও সত্য। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সমাজ–রাজনীতির বহির্জাগতিক ঘটনার অভিঘাতে সন্দ্বীপিত হয়ে আত্মপ্রকাশের অভীপ্সায় কাব্য সৃজন করেছেন। এ জন্য তিরিশের কবিদের চেয়ে তিনি ছিলেন ভিন্নতর ধারার। তবু তিনি নানাভাবে আলোড়িত করেছিলেন তিরিশের কবিদের। বস্তুত শোষণ-বঞ্চিত ও সাম্প্রদায়িক সমাজজীবনে নজরুলের কবিতা আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি আজকের যুদ্ধবিধ্বস্ত বিশ্বে মানুষের দুঃখ-বেদনার সান্ত্বনা হিসেবে আরও বেশি প্রয়োজনীয়।’
এ ছাড়া বন্ধু আবদুল মোহায়মিন, মাজেদুল ইসলাম, সমরজিৎ হালদার, শাহরিয়ার আবির, কিশোর দাস, কৃত্য ছত্রী কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। আলোচনা পর্ব শেষে কাজী নজরুল ইসলামের উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’ নিয়ে পাঠচক্র অনুষ্ঠিত হয়। বন্ধু প্রণব চৌধুরীর আঁকা জাতীয় কবির চিত্রকর্ম এবং বন্ধু ফারহানা হক অমির সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানটি আরও সুন্দর ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।