শরতের আকাশে মেঘের সঙ্গে রোদের লুকোচুরি চলছে সকাল থেকেই। গরমের দাবদাহ যেন কমছেই না। বিকেল হতেই আকাশ কালো করে এল ঝুম বৃষ্টি, শান্ত হলো প্রকৃতি।
এমনই বৃষ্টিস্নাত বিকেলে ১৯ সেপ্টেম্বর মেঘনা নদীর পাড়সংলগ্ন বাংলাদেশ রেলওয়ে উচ্চবিদ্যালয়ে পাঠের আসর নিয়ে বসেন ভৈরবসভার বন্ধুরা। নির্বাচন করা হয় প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই হাঙর নদী গ্রেনেড। এটি ভৈরবসভার ১৬৫তম পাঠের আসর।
বই পড়ার মাধ্যমে জীবন আলোকিত হয়, এই সত্য ভৈরব বন্ধুসভা গুরুত্বের সঙ্গে উপলব্ধি করে। ভৈরবসভা সাড়ে আট বছর ধরে নিয়মিতভাবে বই পড়ার অভ্যাস ছড়িয়ে দিতে কাজ করে যাচ্ছে।
২০১৫ সালের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হয় ভৈরব বন্ধুসভার মুদ্রিত বই পড়ার দলগত আসর পাঠচক্র। চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি সংখ্যাগত দিক দিয়ে ১৫০তম পাঠচক্রের আয়োজন করে। বিশেষ এই সংখ্যাকে ঘিরে পাঠক উৎসব করার ভাবনা আসে। নানা বাস্তবতায় সেটি আর সম্ভব হয়নি। তবে পাঠচক্র চলমান রয়েছে। ভিন্ন কিছু করার পরিকল্পনাও রয়ে যায়। সেই ভাবনা থেকে এবার ‘বই জানি স্বপ্ন বুনি’ শিরোনামে ১৫ দিনে আটটি বই পড়ার বিশেষ কর্মসূচি হাতে নেয় ভৈরব বন্ধুসভা। স্থানীয় আটটি স্কুলে পর্যায়ক্রমে পাঠের আসরগুলো অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিটি আসরে স্কুলশিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিচ্ছে। জানাচ্ছে নিজেদের ভালো লাগার অনুভূতি। ভৈরব আইডিয়াল স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসমিয়া জাহান বলে, ‘বন্ধুসভার পাঠচক্রের জন্যই পাঠ্যবইয়ের বাইরের এই বইটি পড়া হলো, বই আলোচনা থেকে অনেক কিছু শিখলাম।’
১১ সেপ্টেম্বর ভৈরব আইডিয়াল স্কুল প্রাঙ্গণে আয়মান সাদিক ও অন্তিক মাহমুদের আত্মোন্নয়নমূলক বই ভাল্লাগে না দিয়ে আয়োজনটির সূচনা হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর লেখক দন্ত্যস রওশনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কিশোর উপন্যাস নোটুর সেভেনটি ওয়ান বই নিয়ে দ্বিতীয় আসরটি বসে ব্লু-বার্ড স্কুলে। ১৮ সেপ্টেম্বর তৃতীয় পাঠের আসরটি অনুষ্ঠিত হয় ভৈরব উদয়ন স্কুলে। বিষয় ছিল কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশন বই ত্রাতিনা।
প্রতিটি পাঠের আসর ভৈরব বন্ধুসভার ফেসবুক পেজ থেকে লাইভ সম্প্রচার করা হয়। গ্রন্থপ্রেমীদের আগ্রহমূলক অসংখ্য মন্তব্য উঠে আসে। হাঙর নদী গ্রেনেড পাঠচক্রের লাইভে শরীফ উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি লেখেন, ‘এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের একটি বিখ্যাত উপন্যাস। এটি নিয়ে সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। পাঠচক্রের জন্য ধন্যবাদ।’ কামরুন্নাহার কলি অনুভূতি প্রকাশ করে লেখেন, ‘বেশ সুন্দর শিক্ষণীয় একটি প্রোগ্রাম। আমরাও এ রকম প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতে চাই।’ এ ছাড়া ভৈরব উপজেলার বেশ কয়েকটি স্কুল থেকে পাঠচক্র করার জন্য আমন্ত্রণ আসে।
পর্যায়ক্রমে পরবর্তী পাঠচক্রের আসর বসবে ভৈরব পৌর পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, শিমুলকান্দি উচ্চবিদ্যালয়, ভৈরব প্রেসিডেন্সি মডেল স্কুল ও বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলে।
বিভিন্ন পাঠচক্রে আলোচক হিসেবে ছিলেন কার্যনির্বাহী সদস্য প্রিয়াংকা, উপদেষ্টা সুমাইয়া হামিদ, সাধারণ সম্পাদক রিফাত হোসেন, জেন্ডার ও সমতাবিষয়ক সম্পাদক তানশি নাহার, পরিবেশ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক শাহরিয়ার ইবাদ, সাংগঠনিক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন, প্রচার সম্পাদক মহিমা মেধা, পাঠচক্র ও পাঠাগার সম্পাদক জান্নাতুল মিশু ও বন্ধু প্রাপ্তি ঘোষ।
সব পাঠচক্রে উপস্থিত থেকে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক সুমন মোল্লার রয়েছে দারুণ স্মৃতি। তিনি বলেন, ‘বন্ধুসভার যত বিস্তৃতি, সমৃদ্ধি আর অর্জন সবগুলোই পাঠচক্রকে ঘিরে। দীর্ঘ আট বছর ধরে পাঠের আসর চলমান আছে। স্থানীয় মানুষ এখন ভৈরব বন্ধুসভাকে বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখে।’ উপদেষ্টা ওয়াহিদা আমিন পলি পাঠচক্রের নেপথ্যের কারিগর। সবগুলো পাঠচক্রকে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে তাঁর রয়েছে বিশেষ ভূমিকা।
উপদেষ্টা লুবনা হক বলেন, ‘আমার প্রিয় কাজ বই পড়া। নানা ব্যস্ততায় এখন সেই সুযোগ হয়ে ওঠে না। তবে বন্ধুসভার পাঠচক্রের কারণে এখন সেই চর্চা চলমান আছে।’ সাধারণ সম্পাদক রিফাত হোসেনের মতে, তরুণদের মুদ্রিত বইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার প্রয়াস পাঠচক্র। আমাদের আজকের সচল ও সক্রিয় সাংগঠনিক শক্তির মূল ভিত্তি হলো বই পড়া।’
এদিকে বই নিয়ে ভৈরব বন্ধুসভার ব্যতিক্রমী এই আয়োজন শুরু করার পর থেকেই ব্যাপক সাড়া পড়েছে। উপজেলার বিভিন্ন স্কুলের পাশাপাশি কলেজগুলো থেকেও আহ্বান আসছে। তাই ১৫ দিনব্যাপী আয়োজনটি এখন মাসব্যাপী করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পাঠক উৎসবের আগেই যেন ভৈরবে একটি উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হলো।
সভাপতি, ভৈরব বন্ধুসভা