হুমায়ূন আহমেদের লেখা আমাদের হাসায়, আবার কাঁদায়

শিমুলকান্দি উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভৈরব বন্ধুসভার পাঠচক্রের আসর
ছবি: হান্নান হিমু

‘পৃথিবীতে ফিনিক ফোটা জোছনা আসবে।
শ্রাবণ মাসে টিনের চালে বৃষ্টির সেতার বাজবে।
সেই অলৌকিক সংগীত শোনার জন্য আমি থাকব না। কোনো মানে হয়।’
বলছি লেখক হুমায়ূন আহমেদের কথা। নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর লেখনী শক্তি দিয়ে পাঠকদের মোহিত করে রাখেন। তাঁর লিখনশৈলী স্বতন্ত্র, সহজ–সাবলীল লেখায় মুগ্ধ করে রেখেছেন আমাদের। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র হিমু, মিসির আলি, বাকের ভাই, শুভ্র, রূপা, মুনা আজও জীবন্ত। হলুদ পাঞ্জাবিতে কেউ হিমু, নীল শাড়িতে রূপা, আবার কেউবা অনুসন্ধিৎসু চোখে মিসির আলির চরিত্র ধারণ করে। পাঠের আসরে লেখক সম্পর্কে কথাগুলো বলছিলেন ভৈরব বন্ধুসভার কার্যনির্বাহী সদস্য প্রিয়াঙ্কা।

ভৈরব বন্ধুসভার ‘বই জানি স্বপ্ন বুনি’ কর্মসূচিটি শুরু হওয়ার পর থেকে ভৈরবের আশপাশের স্কুল-কলেজ থেকে পাঠের আসর করার আমন্ত্রণ আসতে থাকে। ইউনিয়ন পর্যায়েও বই পড়ার আনন্দ ছড়িয়ে দিতে ২৬ সেপ্টেম্বর বন্ধুসভার টিম হাজির হয় ভৈরব উপজেলার শিমুলকান্দি ইউনিয়নের শিমুলকান্দি উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে। এবারের বিষয় ছিল জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘দারুচিনি দ্বীপ’। ১৬৭তম পাঠের আসরটি সঞ্চালনা করে পাঠচক্র ও পাঠাগার সম্পাদক জান্নাতুল মিশু।

হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে আলোচনা করছেন ভৈরব বন্ধুসভার কার্যনির্বাহী সদস্য প্রিয়াঙ্কা
ছবি: হান্নান হিমু

হুমায়ূন আহমেদের লেখাগুলো যেন জীবনের গল্পের প্রতিচ্ছবি। সাবলীল সংলাপের মাধ্যমে তিনি পাঠককে সম্মোহিত করে রাখেন। হুমায়ূন আহমেদ প্রতিটি লাইনে পাঠকের জন্য চমক রাখেন। তাঁর লেখা আমাদের হাসায়, আবার কাঁদায়। লেখাগুলো আমাদের সম্মোহিত করে রাখে, মনের মাঝে অসীম শূন্যতা তৈরি করে। একটা দীর্ঘশ্বাসকে সঙ্গী করে আমরা যেন গল্পের চরিত্রের মধ্যে ডুবে যাই।

গ্রন্থ আলোচনা করতে গিয়ে সাংগঠনিক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘একদল তারুণ্যের ভ্রমণ ও উচ্ছ্বাসকে কেন্দ্র করে গল্পের পটভূমি লেখা। এই গল্পের চরিত্রগুলো শুভ্র, সঞ্জু, তারেক, মোতালেব, রানা ও অয়ন, আনুশকা, জরি। শুভ্রকে তার বন্ধুরা নাম দিয়েছে কানাবাবা। সে চোখে কম দেখে বলে এই নামকরণ। অন্য বন্ধুদেরও এ রকম নাম রয়েছে যেমন মোটা মেয়েটার নাম অয়েল ট্যাংকার, রোগা মেয়েটির নাম সুতা কৃমি। বন্ধুদের নামকে হাস্যরসভাবে ডাকায় বেশ আনন্দ পাওয়া যায়।’

প্রতিটি চরিত্র চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। দারুচিনি দ্বীপে যাওয়ার পরিকল্পনার সঙ্গে ফুটে ওঠে পারিবারিক সমস্যা, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা, মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের জটিলতাগুলো যেন আমাদেরই জীবনের প্রতিচ্ছবি।
শুভ্রর বাবা তাকে শেখাচ্ছেন, কীভাবে লিডার হয়ে দলের মধ্যে প্রভাব ফেলতে হয়। তিনি তার ক্ষমতা দিয়ে সব সুবিধা করে রেখেছেন, ট্রেনের কামরা পুরো রিজার্ভ, মাইক্রোবাস, দারুচিনি দ্বীপ যাওয়ার জন্য ট্রলার ইত্যাদি। কিন্তু শুভ্র স্বাধীনচেতা, সে তা গ্রহণ করেনি, শুভ্র চাইছে নিজের মতো করে যেতে।

শিমুলকান্দি উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভৈরব বন্ধুসভার পাঠচক্রের আসর
ছবি: হান্নান হিমু

আমরা যাঁরা মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি, তাঁরা মায়ের কাছে সবকিছু বলতে পারলেও বাবার সামনে গেলে ভয়ে কুঁচকে যাই, হার্টবিট বেড়ে যায়। সঞ্জুর বেলায়ও তা–ই হয়েছিল। সঞ্জু তার বাবাকে ভীষণ ভয় পায়, সে তার মাকে জানায়, বাবার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই আমার হার্টবিট স্লো হয়ে যায়। সঞ্জু যখন তারা বাবার রুমে যায় তখন তিনি পত্রিকা পড়ছিলেন। কথা বলার সময় মনে হচ্ছিল কখন বাবার কাছ থেকে বিদায় নেবে। ছোট বোন মুনা চা নিয়ে আসে, চায়ে পিঁপড়া ভাসছিল। সঞ্জু ভেতরে রাগ করলেও কিছু না বলেই পিঁপড়াসহ চা খেয়ে নেয়।

বল্টুর ভালো নাম অয়ন। টিউশনি তার মূল্য উপজীব্য। সে সঞ্জুর ছোট বোন মুনাকে খুব পছন্দ করে। সঞ্জুর সামনে সে প্রাণপণ চেষ্টা করে স্বাভাবিক থাকার, কিন্তু মনের ভাব আর কত দিন গোপন থাকবে। ভালোবাসা গোপন করা যায় না, কোনো একদিন ঠিকই প্রকাশ পেয়ে যায়। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ুয়া মুনা, বেশ বুদ্ধিমতী। সে–ও বল্টু ভাই বলে ডাকে। এতে অয়নের মন খারাপ হয়। মুনার দেওয়া উপহার আর চিঠি পেয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে তার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়।

জরির জীবনে কোনো সুখ নেই। চাচায় বাসার থাকার ফলে স্বাধীনতাও যেন ক্ষুণ্ন। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে হচ্ছে তার। সেখান থেকে সাহস করে বের হয়ে আসে জরি। জরির আলোচনার সময় উপস্থিত শিক্ষার্থীদের চোখ জ্বলজ্বল করছিল। তারাও যেন জরির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে।

সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী হুমাইরা ঐশী বলে, ‘মানুষ যা পছন্দ করে না, তাই তাকে বেশি শুনতে হয়’ এই লাইনটি বাস্তবের সঙ্গে মিলে গেল। প্রায়ই এ রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হই আমরা। ‘দারুচিনি দ্বীপ’ বইটির নাম আমার খুব ভালো লেগেছে। শিক্ষার্থী সানজেনা রহমান বলে, ‘বইটির শেষ অংশটুকুতে যেন একটি আক্ষেপ রয়ে গেল। লেখক কেন তাদের দ্বীপে নিয়ে গেলেন না?’

কুইজ বিজয়ীদের বই উপহার দেওয়া হয়
ছবি: হান্নান হিমু

‘দারুচিনি দ্বীপ’ উপন্যাসে আমরা এক দিকে দেখি তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, আরেক দিকে সামাজিক বাস্তবতা। জীবনের সব কটি দিক লেখক একসূত্রে গেঁথে রেখেছেন, এখানেই হুমায়ূন আহমেদের গল্প পড়ার তৃপ্তি। উপন্যাসটি শেষ হয় সবার ট্রেনে ওঠার মধ্য দিয়ে। এই বইটিতে তিনি সবাইকে সমুদ্রে নিয়ে যাননি, কারণ, লেখক তখনো সমুদ্রে যাননি। পরে ‘রুপালি দ্বীপ’ উপন্যাসে সেই আক্ষেপ তিনি পূরণ করেছেন।

প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক সুমন মোল্লা বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ হলেন বাংলা সাহিত্যের এক নক্ষত্রের নাম। লেখালেখির মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের সাহিত্যে আলোর মশাল জ্বালিয়েছেন। সেই পথ ধরে এখন তরুণ প্রজন্ম এগিয়ে যাচ্ছে।’

কুইজ পর্ব সঞ্চালনা করেন পাঠচক্র ও পাঠাগার সম্পাদক জান্নাতুল মিশু। শিক্ষার্থীরা আগ্রহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে, পর্বটি বেশ জমজমাট হয়। কুইজ বিজয়ীরা হলো সপ্তম শ্রেণির তায়্যিবা রহমান, ইসরাত জাহান, ষষ্ঠ শ্রেণির আফরিন নিঝুম। পুরস্কার তুলে দেন ভৈরব বন্ধুসভার উপদেষ্টা ওয়াহিদা আমিন, সাবেক সহসভাপতি মেহেরুন সুমি, ম্যাগাজিন সম্পাদক রাহিম আহমেদ।

পাঠের আসরে আরও উপস্থিত ছিলেন সহসাংগঠনিক সম্পাদক এরফান হোসেন, প্রচার সম্পাদক মহিমা মেধা, পরিবেশ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক শাহরিয়ার ইবাদ, স্বাস্থ্য ও ক্রীড়া সম্পাদক শাওন দাস, বন্ধু প্রাপ্তি ঘোষ, সাদিয়া সরকার, সানজিদা ইসলাম, হান্নান হিমু। পাঠের আসরটি ভৈরব বন্ধুসভার ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি প্রচারিত হয়।

সভাপতি, ভৈরব বন্ধুসভা