দেশে বাড়ছে আত্মহত্যা: মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলার সুযোগ নেই

গ্রাফিক: শাকিব হাসান

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি ব্যাপক উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। নানা কারণে অবসাদগ্রস্ত তরুণ-তরুণীরা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন। এক জরিপে দেখা যায়, ২০২০ সালে বাংলাদেশে ৭৯ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন মানসিক কারণে আত্মহননের পথ বেছে নেন। ২০২১ সালে সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় ১০১ জন এবং ২০২২ সালে আত্মহত্যা করেন ৫৮৫ জন শিক্ষার্থী। অর্থাৎ ২০২০-২০২২ সালের মধ্যে আত্মহননের হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে আত্মহত্যার হারের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। বছরে প্রতি এক লাখ জনের মধ্যে এই ৭ দশমিক ৩ শতাংশ জনগোষ্ঠী আত্মহত্যা করে থাকেন, যাঁদের বড় অংশই বয়সে তরুণ।

তরুণদের আত্মহত্যার এই প্রবণতা নীরব ঘাতকে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে মানসিক চাপ, ভালোবাসার সম্পর্ককেন্দ্রিক জটিলতা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, বিষণ্নতা, মানসিক অবসাদ, আর্থিক সমস্যা ছাড়াও যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন ধরনের অপমানসূচক কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় আত্মহত্যার প্রবণতার কারণে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্য অ্যাকশন প্ল্যান ২০১৩-২০৩০ অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশও আত্মহত্যার হার বর্তমানের তুলনায় অন্তত এক–তৃতীয়াংশ কমানোর জন্য প্রতিশ্রুতবদ্ধ। এ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) ৩.৪ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে আত্মহত্যার হার কমিয়ে অসংক্রামক রোগের কারণে অকালমৃত্যু প্রতিরোধ এবং মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষাব্যবস্থার উন্নতি করে সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত করা আমাদের অন্যতম অঙ্গীকার।

প্রথম আলো বন্ধুসভা প্রতিনিয়ত নানাবিধ ভালো কাজের মধ্য দিয়ে একটি সুন্দর ও সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে নিরলস কাজ করছে। কিন্তু তরুণসমাজের মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা না গেলে ভালো কোনো উদ্যোগই টেকসই ও ফলপ্রসূ হবে না। তাই এবার তরুণ ও যুবকদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইউনিমেড ইউনিহেলথ ও প্রথম আলো বন্ধুসভা যৌথভাবে দেশের প্রতিটি জেলায় মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রচারণা কার্যক্রম ও বিশেষ কর্মশালা আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে; যা পর্যায়ক্রমে দেশের ৬৪টি জেলা এবং নির্বাচিত ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে।

বন্ধুসভা মনে করে, মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রাথমিক পর্যায়ে হস্তক্ষেপ এবং কার্যকর প্রতিরোধকৌশল জীবন রক্ষাকারী হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে, কখনো কখনো অবসাদগ্রস্ত কারও কথা শোনাটাও খুব জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। সমসাময়িক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুতে তরুণ-তরুণী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে বন্ধুসভা এ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। মানসিক স্বাস্থ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা প্রতিটি মানুষের জীবনে বাস্তবিক অর্থেই প্রভাব ফেলতে এবং হতাশা ও জীবনের মধ্যে পার্থক্য তৈরিতে এ উদ্যোগ বিশেষভাবে কার্যকর হবে।

এ আয়োজন বিষয়ে নিয়ে ইউনিমেড ইউনিহেলথের বিপণন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক সাফায়াত মাহমুদ বলেন, ‘মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া সর্বজনীন অধিকার। প্রথম আলো বন্ধুসভার বন্ধুরা অনেক ভালো ভালো সামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িত। আমরা চাই বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য সেবাদানকারী চিকিৎসকদের সহযোগিতায় সাধারণ জনগণ, বিশেষত তরুণ জনগোষ্ঠীকে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করতে। যাতে তারা নিজেদের এবং পরিবারসহ চারপাশের মানুষের সুন্দর মানসিক স্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করতে উদ্বুদ্ধ করনে ভূমিকা রাখতে পারেন।’

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আহমদ হেলাল বলেন, ‘আমাদের শরীরের পাশাপাশি মনেরও যত্ন নিতে হবে। বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মানসিক চাপ ও বিষণ্নতা ব্যাপক হারে বাড়ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী যত্ন নেওয়া হচ্ছে না। এ জন্য দরকার সচেতনতা ও মানসিক সহায়তা। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হলে বা মনের যত্নের সমস্যা হলে আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবাইকে একযোগে কাজ করা দরকার। বন্ধুসভা এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে তাদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।’

মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিষয়ক এই বিশেষ কর্মসূচির প্রথম ধাপে জেলা পর্যায়ে কর্মশালা পরিচালনার জন্য প্রতিটি জেলার যেকোনো একটি বন্ধুসভা এবং নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা থেকে নির্বাচিত একজন বন্ধুকে নিয়ে ১৮ আগস্ট ঢাকায় প্রথম আলো কার্যালয়ে দিনব্যাপী একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মশালা (টিওটি) অনুষ্ঠিত হবে। কর্মশালায় মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিষয়ক, বিশেষ করে আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কর্মপন্থা নির্ধারণ এবং জেলা পর্যায়ে কর্মশালা আয়োজন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। জাতীয় পর্যায়ে যে ৮০ জন নির্বাচিত বন্ধু কর্মশালায় অংশ নেবেন, তারা স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিটি বন্ধুসভা থেকে বাছাই করা অন্তত ১০০ জন বন্ধুকে নিয়ে স্থানীয়ভাবে একই ধরনের কর্মশালার আয়োজন করবে। সেখানে জাতীয় পর্ষদ থেকে মনোনীত একজন মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসকও যুক্ত থাকবেন।

এই আয়োজন সম্পর্কে যেকোনো তথ্যের জন্য বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেদোয়ান মাহমুদ রেজার (মোবাইল ০১৭১৭৮৫৫৪১৪) সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে।