চারটি পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে ময়মনসিংহ বন্ধুসভার উদ্যোগ

ময়মনসিংহ বন্ধুসভার উদ্যোগে সেলাই মেশিন উপহার
ছবি: বন্ধুসভা

‘আমার একখান এক বছরের ছেরা (ছেলে), একখান চাইর বছরের ছেরি (মেয়ে)। আল্লায় তারারে স্বাভাবিক বানায় নাই। দুইটা সন্তানই প্রতিবন্ধী। ঠিকমতন চিকিৎসা করাইতাম পারি নাই। হেই কারণে দুইটা সন্তানের এই দশা। ছেরার বাপ মাইনষের জমিত কামলা দেয়। যা পায় তাই দিয়ে আমরার ঠিকমতো ভাতই জুটে না। আন্নেরার দেওয়া সেলাই মেশিনডা আমরার ভাগ্যের পরিবর্তন করবে।’

অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে এভাবেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুর ইউনিয়নের পুম্বাইল গ্রামের রাশেদা বেগম। তাঁর স্বামীর নাম ওমর ফারুক। রাশেদা বেগম বলেন, ‘পোলাপাইনের বাপে এলহা (একা) সংসারডা টানতাছে। আমি টুকটাক সেলাই কাজ পারি। আপনেরার এই সেলাই মেশিন দিয়া দিনেরাইতে কাম কইরা অভাব দূর করবাম।’

প্রথম আলোর ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ‘একটি ভালো কাজ’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে চারটি অভাবগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে ময়মনসিংহ বন্ধুসভা। একটি পরিবারকে সেলাই মেশিন এবং তিনটি পরিবারকে তিনটি ছাগল উপহার দেওয়া হয়। ২৩ অক্টোবর ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সোহাগী ইউনিয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে তিনটি পরিবারে হাতে ছাগল তুলে দেন বন্ধুরা।

কুলসুম আক্তারের (৫৮) স্বামী তিন মেয়ে ও এক ছেলে রেখে মারা যান। নিজস্ব বসতভিটা না থাকায় থাকেন পৌরসভার শিমরাইল সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে। বন্ধুদের দেওয়া ছাগল পেয়ে আপ্লুত কুলসুম আক্তার বলেন, ‘একমাত্র উপার্জনক্ষম পোলা শামীম আট মাস ধইরা বাস দুর্ঘটনায় ঘরে পড়া। ছেরা কামলা দিয়া সংসারডা চালাইত। অহন খাইয়া না খাইয়া বাঁইচা রইছি। মানইষের বাইত কাম কইরা জীবনডা বাঁচাইয়া রাখছি। পোলার চিকিৎসাও করাইতে পারতাছি না। তোমরা আমার পুরা মুখে হাসি আনছো। তোমরার দেওয়া ছাগল পাইলা এইডা থাকইক্কাই আরও ছাগল অইবো। আমার কষ্টের সংসারে এইডা অনেক বড়। আল্লাহ তোমরার ভালা করব।’

তিনটি পরিবারকে তিনটি ছাগল উপহার
ছবি: বন্ধুসভা

একই উপজেলার সরিষা ইউনিয়নের মারুয়াখালী গ্রামের আবদুল মান্নান (৫২)। স্ত্রীকে নিয়ে সংসার। কামলা দিয়ে জীবন চলে তাঁর। কিন্তু কয়েক বছর ধরে শরীরে নানা রোগ বাসা বাঁধার কারণে কাজে যেতে পারেন না নিয়মিত। আবদুর মান্নান বলেন, ‘খুব কষ্টে জীবন কাটাইতাছি। আমার একটা সন্তানাদিও নাই। তোমরা আমারে যা দিছ, এইডা বাড়াইয়া অভাব দূর করবাম।’

সরিষা ইউনিয়নের চাপিলাকান্দা গ্রামের ডেকোরেশন মিস্ত্রি আবুল কাশেম স্ট্রোকজনিত কারণে প্রায় পাঁচ বছর ধরে কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। নানা রোগে জীবন কাটছে তাঁর। তিন ছেল ও এক মেয়েকে নিয়ে অথই সাগরে পড়েন স্ত্রী আল্পনা আক্তার। ১৪ বছরের এক ছেলেকে নরসিংদীর মাধবদী পাঠিয়েছেন কামলা দেওয়ার জন্য। আল্পনা আক্তার আশপাশের মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালিয়ে নিচ্ছেন। নিজেদের থাকার খুপরি ঘরটিরও জীর্ণদশা।

মাদ্রাসাপড়ুয়া আট বছরের আবু সিদ্দিককে নিয়ে ছাগল নিতে আসেন আল্পনা আক্তার। ছোট্ট আবু সিদ্দিক ছাগল পেয়ে খুবই খুশি। আল্পনা আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী পাঁচ বছর ধইরা কোনো কামকাজ করতে পারে না। একবার খাইলে দুইবার উবাস (উপবাস) থাহন লাগে। পোলাপানগুলো লইয়্যা ভাঙা ঘরে থাহি (থাকি)। বৃষ্টিতে ভিজি, রইদে (রোদে) শুকাই। আপনাদের দেওয়া এই ছাগল দিয়া দিন দিন আরও বাড়াইবাম।’

এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর ময়মনসিংহ প্রতিনিধি মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বন্ধুরা যে ভালো কাজ করেছে, তা শুধু দায়িত্ব পালন নয়—এটি মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এমন কাজ আমাদের সমাজে আশা জাগায়, অন্যদের অনুপ্রাণিত করে এবং প্রমাণ করে যে, সদিচ্ছা থাকলে পরিবর্তন সম্ভব। এই সুন্দর উদ্যোগের প্রশংসা জানাই। মনে রাখতে হবে, ভালো কাজের প্রকৃত শক্তি লুকিয়ে আছে এর ধারাবাহিকতায়। একদিনের ভালো কাজ নয়, প্রতিদিনের ছোট ছোট সৎ প্রচেষ্টাই গড়ে তোলে বড় পরিবর্তন।’

ময়মনসিংহ বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেন, ‘বন্ধুদের হাতখরচের টাকা বাঁচিয়ে যেটুকু থাকে তাই নিয়ে আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। ময়মনসিংহ বন্ধুসভা মানবিক, সামাজিক ও সৃজনশীল কাজে সব সময়ই সচেষ্ট।’

বন্ধু বোরহান উদ্দিন প্রথমবারের মতো ভালো কাজে অংশগ্রহণ করে উচ্ছ্বসিত। বলেন, ‘ভালো কাজে যাদের স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করা হয়েছে, তাদের মুখের হাসি দেখতে পাওয়ার যে অনুভূতি, সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ভালো কাজগুলো এমনই হওয়া উচিত।’

জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সার্বিক নিদের্শনায় ‘একটি ভালো কাজ’ কর্মসূচি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করতে স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা করেন উপদেষ্টা এখলাস উদ্দিন খান, শওকত হোসেন, নাসিমা আক্তার, তাহমিনা আক্তার, সভাপতি মোহাম্মদ খালিদ হাসান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন মুসাফির, বন্ধু রাকিবুল ইসলাম, আরিফুল হক, এহসানুল হক, নাঈম বাশার, সাইফুল ইসলামসহ অন্য বন্ধুরা।

সভাপতি, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা