ভ্রমণ করতে ভালো লাগে না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কেউ ঘুরতে চান দল নিয়ে তো কেউ চান একাকী। কাউকে টানে পাহাড়, কাউকে সমুদ্র তো কাউকে কংক্রিটের বিশাল বিশাল অট্টালিকা। তবু ভ্রমণে যে যেতেই হবে, গণ্ডীর বাইরে থেকে উপভোগ করতে হবে পৃথিবীটাকে। একবার ফরাসি ঔপন্যাসিক গুস্তাভ ফ্লোবের বলেছিলেন, ‘ভ্রমণ মানুষকে পরিমিত করে তোলে। আপনি দেখতে পান যে আপনি পৃথিবীতে কত ছোট জায়গা দখল করে আছেন।’
রহস্যময়তা আর অপার সৌন্দর্যের এই পৃথিবীতে দেখার যেন শেষ নেই। এমনই মনোহর সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে আমাদের বাংলাদেশেও। অপরূপ দৃশের কোনো কমতি নেই এই দেশে। বাংলার সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে বিখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।’
বাংলার এই মাধুর্যে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, সাজেক ভ্যালি, তাজিংডং পাহাড়, গারো পাহাড়, পদ্মা-মেঘনা–যমুনাসহ শত শত নদীর অবদান। প্রকৃতির এই দারুণ সৌন্দর্যের সঙ্গে কিছু মানবসৃষ্ট সৌন্দর্যও দারুণভাবে অভিভূত করে রেখেছে সবাইকে। কাছে টেনে নিচ্ছে। এমনি একটি মানবসৃষ্ট অপরূপ নিদর্শনের নাম ‘দীপশিখা মেটি স্কুল’।
দিনাজপুর শহর থেকে উত্তর-পশ্চিমে ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দীপশিখা মেটি স্কুলটি সম্পূর্ণ বাঁশ, মাটি, খড়, নারকেলের দড়ি, তালের ডগা ইত্যাদি দেশীয় সরঞ্জামের নিখাদ বাঙালি স্থাপনা। এটি দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার রুদ্রপুর গ্রামে অবস্থিত। বাঁশ-বেত আর পলিমাটির মিশেলে গড়া স্কুলটি যেন এ যুগের শান্তিনিকেতন। এখানে বাচ্চারা পড়ে মনের আনন্দে, শেখে হাতে-কলমে প্রকৃতির ছায়ায়।
জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার ১০ ছাত্র ও বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্থানীয় ১৯ শ্রমিকের সমন্বয়ে এই স্কুল নির্মিত হয়েছে। ২০০৭ সালে আগা খান স্থাপত্যকলা পুরস্কারে ভূষিত হয় দীপশিখা মেটি স্কুল।
বন্ধুসভা সব সময় ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও পর্যটনকেন্দ্রিক স্থানগুলোকে গুরুত্ব দেয়। সেসব জায়গায় গিয়ে আত্মার প্রশান্তি নেওয়ার পাশাপাশি পাঠচক্র ও স্থানটির ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন বন্ধুরা।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৪ আগস্ট দিনাজপুর বন্ধুসভার বন্ধুরা ভ্রমণে বের হন মৃৎ কারুকার্য ও ইতিহাসসমৃদ্ধ দীপশিখা মেটি স্কুল দেখার উদ্দেশ্যে। সাধারণ সম্পাদক শুভ রায়ের নেতৃত্বে ভ্রমণে সঙ্গী হন ২০ বন্ধু। সভাপতি মুনিরা শাহনাজ চৌধুরী বলেন, ‘প্রাচীনতা বরাবরই আমাদের মুগ্ধ করে। প্রাচীনতা আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবন যাপনের চিত্র তুলে ধরে। দীপশিখা মেটি স্কুল এমনি এক স্থাপনা, যা আমাদের দেশের হাজার বছরের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে লালন করে।’
দীপশিখা মেটি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষিকা বলেন, ‘এখানে পাঠদান করতে পারাটা আমার জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া। সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে থেকে যেমন আত্মার তৃপ্তি পাই, তেমনি শিশুদের পাঠদানের মধ্যে পাই নিজের সত্তাকে। দেশ-বিদেশের নানা পর্যটক এসে যখন আনন্দিত ও বিমোহিত হন, তখন নিজের গর্ববোধটুকু আরেকটু বৃদ্ধি পায়।’
‘এখানে এসে সবার সঙ্গে দারুণ সময় উপভোগ করলাম। কোনো এক দিন এই সবুজ ঘাসের ওপর বসে পাঠচক্রে মিলিত হব আবার সবাই,’ বলছিলেন বন্ধুসভার বন্ধু শবনম মুস্তারিন। ভ্রমণগুলো আমাদের আরও আনন্দদায়ক হোক। মেতে উঠি উল্লাসে, ঘুরে দেখি বিশ্ব। গণ্ডী পেরিয়ে পাহাড়–সমুদ্র সব ছুঁয়ে দেখি। তবেই তো জীবনের সার্থকতা। তবেই তো জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পাব আমরা।
তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক, দিনাজপুর বন্ধুসভা