তৎকালীন সমাজে নারীদের করুণ অবস্থার চিত্র ‘অবরোধবাসিনী’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার পাঠচক্র

রমজান ও ঈদের ছুটিতে সবাই বাড়িতে। তাই বলে আড্ডা দেওয়া তো আর বন্ধ করা যায় না। আর সেটা যদি বই আড্ডা হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। ১৭ এপ্রিল বেগম রোকেয়া রচিত ‘অবরোধবাসিনী’ বইটি নিয়ে পাঠচক্র করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা। অনলাইনে আয়োজিত এই পাঠচক্র বা বই আড্ডায় অন্তত ১৫ বন্ধু অংশ নেন।

বইটিতে লেখক তাঁর সঙ্গে এবং আশপাশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন মুসলিম সমাজে নারীদের করুণ অবস্থার চিত্র চমৎকার লেখনীর মাধ্যমে রম্য গল্প আকারে তুলে ধরেছেন। নারীর ক্ষমতায়নে বেগম রোকেয়াকে উদ্বুদ্ধ করার পেছনে আসলে কোন ধরনের সমাজব্যবস্থার বেড়াজাল দায়ী ছিল, সেটাও এই বইয়ে হাস্যরসের মাধ্যমে অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

পাঠচক্রের আলোচনায় বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সামিয়া আক্তার বলেন, ‘অবরোধবাসিনী বেগম রোকেয়া রচিত একটি গ্রন্থ। যেখানে তিনি তৎকালীন ভারতবর্ষে মুসলিম নারীদের পর্দা প্রথা রক্ষার নামে কঠোর অবরোধ প্রথাকে দেখিয়েছেন। তিনি তাঁর আশপাশে ঘটা বিভিন্ন কাহিনি ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনাকে হাস্যরসের মাধ্যমে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। সে সময় পর্দা প্রথার নামে গোঁড়ামির পরিচয় পাওয়া যায়। যেখানে ধর্মকে পালনের নামে অন্ধ হয়ে ছিল তৎকালীন নারী সমাজ। এই অবরোধের সঙ্গে তারা কতটা নিজেদেরকে যুক্ত করে নিয়েছে, তার প্রমাণ মিলে কিছু ছোটগল্পে। যেমন একবার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের স্ত্রী এক দাওয়াতে যোগ দিতে পালকি চড়ে পৌঁছান। কিন্তু যথাসময়ে তাঁকে কেউ নিতে না আসায় সে নিজে থেকে তো নামেননি বরং বেয়ারারা পালকি নিয়ে চলে যাওয়ার সময়ও তিনি ও তার শিশু বাচ্চাকে কোনো টু শব্দ করতে দেননি। সারা রাত সেই পালকিতেই কাটিয়েছেন নিঃশব্দে। পরদিন তাঁর খোঁজ পেয়েছিল সবাই। আবার অনেক ঘটনাতে উল্লেখ্য হয় যে তখনকার সময়ে বিয়ের আগে মেয়েদের প্রায় এক মাসের বেশি সময় লোকচক্ষুর আড়ালে রাখা হতো।’

দর্শন বিভাগের প্রথম বর্ষের বন্ধু জেসমিন জালাল বলেন, ‘বাঙালি নারী মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ, জ্ঞানানুরাগী, দৃঢ়চেতা ও মহীয়সী এক নারীর ১৯৩১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থটির প্রেক্ষাপট বর্তমান সময়ে এসে প্রাসঙ্গিক এবং অপ্রাসঙ্গিক—এ দুয়ের মাঝামাঝি অবস্থানে বিরাজ করছে। বলছি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন রচিত ‘অবরোধবাসিনী’ বইটির কথা। প্রায় একানব্বই বছর আগে হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে পর্দা প্রথার গোঁড়ামি নিয়ে ৪৭টি অবরোধ ব্যবস্থার বর্ণনা আপনাকে হাসাবে আবার কখনো কখনো অবাক করবে। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সময়ে এমন গ্রন্থ লেখা অতিমাত্রায় দুঃসাহসিক কাজ; যেখানে চোর আসায় পর্দা ভেঙে যাবে ভেবে বিবিগণ সদিচ্ছায় নিজেদের গয়না চোরের হাতে তোলে দেয় অথবা রোকেয়ার এক সুসম্পর্কের মামি পর্দা রক্ষায় ট্রেনে চাপা পড়ে ১১ ঘণ্টা কষ্ট করে মৃত্যুবরণ করেন। কী বিভৎস! আবার এই পর্দা প্রথার গোঁড়ামির কারণে এক বিবি তাঁর স্বামীকে কোনো দিন ভালোভাবে না দেখায় বাইরে বেরিয়ে ভিন্ন পুরুষের পেছনে পেছনে চলে যায় নিজের স্বামী ভেবে। বইটিতে যে পর্দা প্রথার বর্ণনা আছে, তা এই বর্তমান সময়ে এসে খানিকটা হাস্যরসাত্মক হলেও আমাদের কিছু কিছু সমাজব্যবস্থায় চিন্তাচেতনার দিক থেকে এটি প্রায় প্রাসঙ্গিক।’

চবি বন্ধুসভার পাঠচক্র সম্পাদক আফিয়া আনজুম বলেন, ‘এ বইটি পড়ার আগে আমরা সবাই জানতাম যে ওই সময় পর্দা অনেক ভয়াবহ ছিল। আমরা এটাও জানি যে বেগম রোকেয়া নারী জাতির জন্য এর অন্তরাল থেকে বের করার জন্য যে প্রগতিশীল চিন্তা করেছিলেন, সেটা আজকাল বা তখনকার প্রেক্ষাপটে অনেক দামি কিছু। সবকিছু মেনে নেওয়ার একটা সীমানা থাকে, যখন সীমানাটা অতিক্রম করে যায় আমরা দেখি কোনো না কোনো দিক থেকে কেউ না কেউ সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। বেগম রোকেয়া ছিলেন সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী শক্তি।’

প্রচার সম্পাদক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা