খেলাধুলা, ভ্রমণ আর ইতিহাসের সন্ধানে খুলনা বন্ধুসভার এক দিন
খুলনা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ভরতের দেউল। খুলনা-যশোর সীমান্তে কেশবপুর উপজেলার ভদ্রা নদীর পশ্চিম তীরে ভরত ভায়না গ্রাম। সেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আনুমানিক দেড় হাজার বছরের বেশি আগের এক পুরাকীর্তি। অনেকটা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের মতো দেখতে এই প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনটি স্থানীয় জনগণের কাছে দীর্ঘদিন যাবৎ ভরতের দেউল বা ভরত রাজার দেউল নামে পরিচিত। প্রত্নতত্ত্ব–বিশেষজ্ঞরা এখানকার ব্যবহৃত ইট ও প্রাপ্ত বিভিন্ন পোড়ামাটির মূর্তি গবেষণা করে নিশ্চিত হয়েছেন, এটি খ্রিষ্টীয় তিন থেকে ছয় শতকে নির্মিত একটি মন্দির।
১১ মে ভরতের দেউলে চড়ুইভাতি করেছে খুলনা বন্ধুসভা। সোনালি রোদ, মৃদু বাতাস, পাখির গান—সব মিলিয়ে যেন এক অপরূপ স্বর্গরাজ্যের হাতছানি সেখানে। সকালে গন্তব্যে পৌঁছানোর পর নতুন চালের এবং বিভিন্ন মসলার পায়েসের সঙ্গে রুটি খেতে খেতে প্রস্তুতি চলে মজার সব গেমসের। দিনব্যাপী এই আয়োজনে ছিল চোখ বেঁধে একে অপরকে আইসক্রিম খাওয়ানো, সুচে সুতা ঢোকানো, তিনজনে দলবেঁধে হাতে পানি নিয়ে পাত্র বোঝাই এবং বেলুনদৌড়।
তপ্ত দুপুর, ঝলসানো রোদে শীতল পরশ খোঁজায় ব্যস্ত উদাস মন নিয়ে ঘোরাঘুরি শেষে বন্ধুরা যান দেড় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বন্ধু আবু সিদ্দিক অভির ফলবাগানে। দুপুরে খাওয়ার পর বন্ধুরা ক্লান্তি দূর করতে একটু বিশ্রাম নেন। তেজোদীপ্ত সূর্য যখন তার যৌবনের রূপ হারাতে শুরু করল, তখন সবাই রওনা হন কাঠা দশেক জায়গাজুড়ে শতবর্ষী বটগাছ পরিদর্শনে কেশবপুরের ভেরচী গ্রামে। স্থানটি বৃহৎ বটতলা বা কালীতলা নামে পরিচিত।
খুলনা বন্ধুসভার সভাপতি কাজী মাসুদুল আলম বলেন, ‘যেকোনো সফর আমাদের অনেক কিছু শিক্ষা দেয়। পুরাকীর্তি থেকে আমরা আমাদের ইতিহাস–ঐতিহ্য জানতে পারি, বধ্যভূমি থেকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারি।’
বিকেল গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুদের গন্তব্য ছিল যশোরের ঐতিহ্যবাহী নিমতলা মহাশ্মশানে। এটি ভেরচী গ্রামের পালপাড়ায় অবস্থিত। এখানে বিদেশি সনাতনীদের উপস্থিতিতে বৃহৎ নামযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়।
সেখান থেকে বন্ধুরা যান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চুকনগর বধ্যভূমিতে। খুলনার চুকনগরে ১৯৭১ সালের ২০ মে সবচেয়ে বড় গণহত্যাটি সংঘটিত হয়। ঘটনার কয়েক দিন আগে থেকে যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য শরণার্থী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হয়ে বাঁচার তাগিদে ভারতে যাওয়ার জন্য এই চুকনগরে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। চুকনগরকে তাঁরা ভারতে যাওয়ার ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। ২০ মে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টা নাগাদ সাতক্ষীরা সড়ক ধরে পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি ট্রাক (মতান্তরে তিন-চারটি) এসে চুকনগরে পৌঁছায় এবং শরণার্থীদের ওপর নির্বিচার গুলি চালাতে থাকে। চার-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে চুকনগর পরিণত হয় মৃতদেহের জনপদে। ধারণা করা হয়, মৃতের সংখ্যা ছিল ৬ থেকে ১০ হাজার।
ফেরার পথে গান, কবিতা ও আড্ডার সঙ্গী হলো ফুটফুটে সুন্দর চাঁদ।
সাংগঠনিক সম্পাদক, খুলনা বন্ধুসভা