পাঠচক্র চিন্তাশক্তি বিকাশের একটি মাধ্যম

বই নিয়ে আলোচনা করছেন রাজশাহী বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক তাহমিনা আক্তার

সফিক ইসলামের লেখা ‘পিথাগোরাসের জগৎ’ বই নিয়ে পাঠচক্র করেছে রাজশাহী বন্ধুসভা। ১৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে প্রথম আলোর রাজশাহী অফিসে এটি অনুষ্ঠিত হয়। পাঠাগার ও পাঠচক্র সম্পাদক ঔড়ব আজাদের সঞ্চালনায় পাঠচক্রে গ্রিক দার্শনিক ও গণিতবিদ পিথাগোরাসের গণিত ও সংগীতের মধ্যে গভীর সম্পর্ক, তাঁর বিশ্বাস এবং জীবনের ট্র্যাজেডি নিয়ে আলোচনা করা হয়।

সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা সবাই পিথাগোরাসের নাম শুনেছি। তাঁকে গণিতবিদ হিসেবে চিনি। কিন্তু তিনি যে গণিতের পাশাপাশি সংগীতচর্চার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন, এ বিষয়ে আমরা অনেকেই জানি না। তিনি সংগীতের সঙ্গে গণিতের সম্পর্ক খুঁজে বের করেন। লক্ষ করেছিলেন যে যদি একটি তারের দৈর্ঘ্য পরিবর্তন করা হয়, তবে তা থেকে উৎপন্ন স্বরের উচ্চতাও পরিবর্তিত হয়। পিথাগোরাস প্রথম আবিষ্কার করেন সংগীতের স্বর ও সুরের পেছনে নির্দিষ্ট গাণিতিক অনুপাত। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো তারের দৈর্ঘ্য অর্ধেক করা হয়, তবে তা এক অক্টেভ উচ্চতর স্বর তৈরি করে। এই গবেষণা থেকে তিনি সংখ্যার হারমোনি (Harmony of Numbers) তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন, যা সংগীতের স্কেল ও সুরের গাণিতিক ভিত্তি ব্যাখ্যা করে। এই আবিষ্কার আজকের সংগীততত্ত্বের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।’

সাধারণ সম্পাদক তাহমিনা আক্তার পিথাগোরাসের মৌলিক সুরতত্ত্বের আবিষ্কার নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক ও গণিতবিদ পিথাগোরাস শুধু জ্যামিতিতেই অবদান রাখেননি, বরং সংগীতের সঙ্গে সংখ্যার সম্পর্কও আবিষ্কার করেছিলেন। একদিন তিনি একজন কামারের দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হাপরের শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ান। লক্ষ করেন, কামারের হাতুড়ির আঘাতে ভিন্ন ভিন্ন ধ্বনি তৈরি হচ্ছে এবং কিছু নির্দিষ্ট সুরেলা সম্পর্ক বিদ্যমান। এতে তাঁর মনে হয়, সুরের সঙ্গে সংখ্যার গভীর সম্পর্ক থাকতে পারে। এরপর তিনি পরীক্ষা করে দেখেন, কোনো তারের দৈর্ঘ্য নির্দিষ্ট অনুপাতে পরিবর্তন করলে ভিন্ন সুর তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি তারের দৈর্ঘ্য যদি অন্যটির অর্ধেক হয়, তবে তা মূল সুরের তুলনায় এক অক্টেভ উঁচু হয়। এই ভিত্তিতে তিনি একটি একতারা–জাতীয় বাদ্যযন্ত্র তৈরি করেন, যা সুর ও সংখ্যার সম্পর্ক বুঝাতে সাহায্য করে। পরবর্তী সময়ে তাঁর এই আবিষ্কার থেকেই পাশ্চাত্য সুরতত্ত্বের ভিত্তি গড়ে ওঠে।’

জেন্ডার ও সমতাবিষয়ক সম্পাদক পূরবী রয়ের আলোচনায় উঠে আসে পিথাগোরাসের জীবনের ট্র্যাজেডি। তিনি বলেন, ‘পিথাগোরাস বিশ্বাস করতেন, সবকিছু পূর্ণসংখ্যা বা ভগ্নাংশে প্রকাশযোগ্য। কিন্তু তাঁর শিষ্য হিপাসাস অমূলদ সংখ্যা (যেমন √২) আবিষ্কার করে এই বিশ্বাসে আঘাত হানেন। পিথাগোরাস এই আবিষ্কার মেনে নিতে পারেননি এবং পণ্ডিতদের বিশ্বাস অনুযায়ী, হিপাসাসকে শাস্তি দিয়ে সমুদ্রে ডুবিয়ে মারা হয়। এই ঘটনা পিথাগোরাসের জীবনে একটি গভীর ট্র্যাজেডি তৈরি করে, যেখানে তাঁর নিজের বিশ্বাসই একজন শিষ্যকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।’

রাজশাহী বন্ধুসভার পাঠের আসর

সহসভাপতি উৎসব সরকার পাঠচক্র আয়োজন অব্যাহত রাখার আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘এ ধরনের আয়োজন জ্ঞানচর্চা ও বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে। জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে ও চিন্তার গভীরতা বাড়াতে এমন পাঠচক্রের কোনো বিকল্প নেই। পাঠচক্র কেবল বই পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি চিন্তাশক্তি বিকাশের একটি মাধ্যম, যা আমাদের ভাবনার জগৎকে আরও প্রসারিত করে।’

পাঠচক্র শেষে দুর্যোগ ও ত্রাণ সম্পাদক নিশাত তাসনিমের তৈরি কেক কেটে অনুষ্ঠান শেষ করা হয়। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলো রাজশাহীর নিজস্ব প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, রাজশাহী বন্ধুসভার সহসভাপতি পরওয়ার হোসেন, দপ্তর সম্পাদক সুশীল চন্দ্র পাল, সাংস্কৃতিক সম্পাদক নাহিদ হাসান, কার্যনির্বাহী সদস্য কাজী হিমেলসহ অন্য বন্ধুরা।

পাঠাগার ও পাঠচক্র সম্পাদক, রাজশাহী বন্ধুসভা