মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে বন্ধুসভার বন্ধুদের মানবিক সাড়া
উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে কিছুটা দূরেই ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ক্যাম্পাস। ২১ জুলাই বেলা একটারও কিছু পরে যখন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়, তখন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি বন্ধুসভার কয়েকজন বন্ধু ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসেই ছিলেন। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে তাঁরা দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান। সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে উদ্ধার কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
মুহূর্তেই দুর্ঘটনাস্থল লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। মূল রাস্তা থেকে কলেজ ক্যাম্পাসে অ্যাম্বুলেন্স আসার জন্য মানুষকে সরিয়ে পথ তৈরি করা ও আহত ব্যক্তিদের অ্যাম্বুলেন্সে কাছের হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেন বন্ধু মনির, নুর আলম, আরিফ, হৃদয়, তন্ময় বিশ্বাসসহ আরও অনেকে।
আহত ব্যক্তিদের জীবন বাঁচাতে সময়মতো রক্ত সরবরাহ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি বন্ধুসভার কিছু সদস্য গিয়ে উপস্থিত হন উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে। রক্ত দিয়েছেন বন্ধু আবির, আদনান, তন্ময়, জিসান ও সাকিব। এ সময় অন্যদেরও রক্তদানে উৎসাহিত করেছেন। রক্তদাতা সংগ্রহে সাহায্য করেছেন বন্ধু শাহরিয়ার কাদির, ঐশী ও মুনিয়া।
বিমান বিধ্বস্তের সংবাদ শুনে তাৎক্ষণিকভাবে গাজীপুর থেকে ছুটে আসেন গাজীপুর বন্ধুসভার বন্ধু আরিফ হোসেন, নাসিরুদ্দিন, সামিউল ইসলাম, ইসমাইল ও অনীক। আহত ব্যক্তিদের যেসব হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, সেই হাসপাতালগুলোয় তাঁরা দুপুর থেকে মাঝরাত অবধি স্বেচ্ছাসেবীর কাজে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ রক্তের ডোনারদের তথ্য সংগ্রহ করেন, কেউ রক্ত দিতে আগ্রহীদের রক্তের গ্রুপ ও মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করেন, কেউ অ্যাম্বুলেন্স আসা–যাওয়ার জন্য ট্রাফিকের কাজ করেন।
দ্বিতীয় দিনও একদল বন্ধু গাজীপুর থেকে এসে স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করেন। তাঁরা হলেন তরিকুল ইসলাম, আবিদা সুলতানা, রুমানা ইসলাম, মিম, ইমরান পাটোয়ারী, হাসান খান মাসুদ, রাহাত, রামিম ফেরদৌস ও মেহেদী। গাজীপুর বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসেন বলেন, ‘এই শিশুদের পাশে দাঁড়ানো মানুষ হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। তাই ছুটে আসা।’
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অন্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার বন্ধুরা। ঢাবি বন্ধুসভার মেহেদি হাসান, কামরুন্নাহার আলো, সৈয়দ জাহিদ হাসান, আহসান হাবিব, মামুন খান, নাফে বিন মামুন ও আবরার লাবিব আহত ব্যক্তিদের জন্য রক্ত সংগ্রহে কাজ করেছেন। এর মধ্যে কয়েকজন বন্ধু রক্তদান করেন। এ বিষয়ে ঢাবি বন্ধুসভার সভাপতি মেহেদি হাসান বলেন, ‘মানবিকতার জায়গা থেকে ঢাবি বন্ধুসভার বন্ধুরা নিজেরা রক্তদান ও রক্ত দিতে পারবে, এমন ব্যক্তিদের খোঁজ করা ও হাসপাতালের সামনে যানজট নিরসনে কাজ করেছেন।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার শিহাব উদ্দীন, নাহিন জামান ও শিহাব আলী কাজ করেছেন যানজট নিরসনে, যাতে অ্যাম্বুলেন্সগুলো নির্বিঘ্নে হাসপাতালে আসা–যাওয়া করতে পারে।
এ ছাড়া যেকোনো ধরনের মানবিক সহায়তার জন্য বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে একটি টিম গঠন করা হয়। সাংগঠনিক সম্পাদক নেওয়াজুল মওলার নেতৃত্বে এই টিমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যামব্রিয়ান কলেজসহ ঢাকার বিভিন্ন বন্ধুসভার সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাঁরা রক্তদাতাদের একটা তালিকা তৈরি করেন। পাশাপাশি ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের যেকোনো সহায়তার জন্য একটি হটলাইন চালু করা হয়।
ঘটনার পর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে গিয়েছিলেন জাতীয় পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন মল্লিক। তিনি দেখেন, অ্যাম্বুলেন্স চলাচলে মারাত্মক সমস্যা হচ্ছে। সেখানে থাকা স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে মিলে যানজট নিরসনে কাজ করেন তিনি। ফরহাদ হোসেন মল্লিক বলেন, ‘আমাদের প্রার্থনা, এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা যেন আর না ঘটে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকেরা যেন এমন একটি নিরাপদ ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলেন, যেখানে সবাই নিশ্চিন্তে বাস করতে পারবে।’
বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করা বন্ধুদের সাধুবাদ জানিয়ে জাতীয় পর্ষদের সভাপতি জাফর সাদিক বলেন, ‘দেশের যেকোনো দুর্যোগে বন্ধুসভার বন্ধুরা স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করে থাকেন। এবারও মাইলস্টোনের ঘটনায় ব্যতিক্রম হয়নি। আমরা দেখলাম, বিভিন্ন বন্ধুসভার বন্ধুরা নিজ উদ্যোগে তাৎক্ষণিকভাবে স্বেচ্ছাসেবায় এগিয়ে আসেন। কেউ সরাসরি দুর্ঘটনাস্থলে চলে যান, কেউ হাসপাতালগুলোয় গিয়ে নিজে রক্ত দেন, অন্যদের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করায় সহায়তা করেন, কেউ হাসপাতালের সামনে যানজট নিরসনে কাজ করেন। বন্ধুদের এই আন্তরিকতা ও স্বেচ্ছাসেবার মানসিকতা বাংলাদেশকে স্বপ্ন দেখায়। সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমাদের বন্ধুরা যেভাবে নিবেদিতভাবে কাজ করছে, এতে আমরা অনেক বেশি আনন্দিত।’