হরিশংকর জলদাসের লেখা ‘আমি মৃণালিনী নই’ উপন্যাসটি মূলত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহধর্মিণী মৃণালিনীকে কেন্দ্র করে রচিত। মৃণালিনী, যাঁর আসল নাম ভবতারিণী। বিয়ের সময় তাঁর নাম পরিবর্তন করে মৃণালিনী রাখেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। উপন্যাসটি মূলত মৃণালিনীর দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা, যেখানে তিনি তাঁর দাম্পত্যজীবন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সম্পর্ক ও সেই সময়ের সামাজিক পটভূমি তুলে ধরেছেন।
‘আমি মৃণালিনী নই’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে এবং এটি প্রকাশ করে প্রথমা প্রকাশন। উপন্যাসটি নিয়ে ১৯ জুন পাঠচক্রের আসর করেছে মুরারিচাঁদ কলেজ বন্ধুসভা।
পাঠ আলোচনায় বন্ধুরা বলেন, ‘“আমি মৃণালিনী নই” উপন্যাসটি কোনো আত্মজীবনী নয়। নয় কোনো ইতিহাসের দলিল। এটি শুধু একটি উপন্যাস। জীবনঘনিষ্ঠ লেখক হরিশংকর জলদাস অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় তুলে এনেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহধর্মিণীর মনের চিত্র। আদতে ওনার মনের চরিত্রের সঙ্গে এ উপন্যাসের বর্ণনা কতখানি সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে তখনকার সময়ের সামাজিক অবস্থা, সেখানে নারীর অবস্থান, এসব বিষয়ে এ উপন্যাসে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের বিবরণ উঠে এসেছে বিস্তারিতভাবে। মৃণালিনী দেবীর বর্ণনায় আমরা আবিষ্কার করি ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে। আসলে সৃষ্টিশীল মানুষের অনেকগুলো মাত্রা থাকে। আমরা কখনোই তাঁদের সব মাত্রা একসঙ্গে অনুধাবন করতে পারি না। তাই তাঁদের নিয়ে হয় গবেষণা, আবিষ্কার করা হয় নতুন নতুন মাত্রা ও মূল্যবোধ। আর এসবের পাশাপাশি সৃষ্টিশীল মানুষেরা আবার এ সমাজেরই একজন। তাই তাঁদের ব্যক্তিত্বের একটা সামাজিক ও সাংসারিক দিকও থাকে।’
উপন্যাসের শুরুটা হয়েছে যে রাতে ভবতারিণী দেবী ঠাকুরবাড়িতে বউ হয়ে আসেন, সেখান থেকে। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর। এ উপন্যাসে ভবতারিণী দেবী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সব সময় রবিবাবু বলে সম্বোধন করেছেন। এসবের মধ্যে মায়াময় দুটি চোখ। এ ছিল রবিবাবুর বাহ্যিক বর্ণনা। ভবতারিণী দেবী কখনোই মন থেকে তাঁর নাম পরিবর্তনের বিষয়টি মেনে নেননি। বাস্তবতার নিরিখে চিন্তা করলে সেটা সম্ভবও ছিল না।
প্রায় ১৯ বছরের দাম্পত্যজীবনের শেষে যখন তিনি তিন কন্যা আর দুই পুত্রের জন্ম দিয়েছেন, তখনই হঠাৎ তাঁর ইচ্ছা হয় লেখার। তাঁর মতে, বাইরের মানুষ জানেন, রবিবাবু আর মৃণালিনী দেবীর দাম্পত্যজীবন অনেক সুখের। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কখনোই সেটা ছিল না। রবিবাবু মৃণালিনী দেবীকে তাঁর বউঠান কাদম্বরী দেবীর মতো ভালোবাসেননি।
মৃণালিনী রবিবাবুর কাছে এতটাই সাধারণ ছিলেন যে তাঁর কাছে তাঁর মনের চিন্তাভাবনা ও আকুলতা প্রকাশ করা যায় না। নিজের অন্তরের কথাগুলো অকুণ্ঠভাবে প্রকাশের জন্য রবিবাবু কখনোই তাঁকে বেছে নেননি। রবিবাবু তাঁর স্বামী ছিলেন, কিন্তু প্রেমিক স্বামী নন।
উপন্যাসের শেষ হয় মৃণালিনীর মৃত্যুর ভেতর দিয়ে। এই উপন্যাসের মাধ্যমে লেখক হরিশংকর জলদাস রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর জীবনের এক অজানা দিক তুলে ধরেছেন, যা পাঠকের কাছে মৃণালিনীর জীবনকে নতুনভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ করে দেয়। যদিও উপন্যাসটির সত্যতা নিশ্চিত করতে গেলে এক শ তে এক শ প্রমাণ করা যাবে না। তবে বলতেই হয়, লেখক তাঁর নিজের মন ও মস্তিষ্কের মাধুরী মিশিয়ে উপন্যাসটি লিখেছেন, সেটা নিঃসন্দেহে প্রকাশ পেয়েছে।
পাঠচক্রে উপস্থিত ছিলেন বন্ধু মেহেদী হাসান, উদয় সরকার, অনুপ দাস, মামুনুর রশীদ, রূপক চক্রবর্তী, নোমান আহমেদ, সাহান আহমেদসহ আরও অনেকে।
পাঠাগার ও পাঠচক্র সম্পাদক, মুরারিচাঁদ কলেজ বন্ধুসভা