বই পড়ার পাশাপাশি স্বপ্ন দেখতে হবে ভালো মানুষ হওয়ার

পাঠচক্র নিয়ে শিক্ষার্থীর অনুভূতি
ছবি: আনাস খান

শরতের আকাশে মেঘের সঙ্গে রোদের লুকোচুরি চলছে সকাল থেকেই। গরমের দাবদাহ যেন কমছেই না। বিকেল হতেই আকাশ কালো করে এল ঝুম বৃষ্টি, শান্ত হলো প্রকৃতি।

এমনই বৃষ্টিস্নাত বিকেলে ১৯ সেপ্টেম্বর পাঠের আসর নিয়ে বসেন ভৈরবসভার বন্ধুরা। ‘বই জানি স্বপ্ন বুনি’ শিরোনামে ১৫ দিনব্যাপী ৮টি বই পড়ার বিশেষ কর্মসূচির চতুর্থ আয়োজনটি হয় মেঘনা নদীর পাড়ের বাংলাদেশ রেলওয়ে উচ্চবিদ্যালয়ের পাঠাগারের কক্ষে। এবারের বিষয় ছিল প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। ১৬৫তম পাঠের আসরটি সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক রিফাত হোসেন।

গ্রন্থ আলোচনার শুরুতে লেখক সেলিনা হোসেনকে নিয়ে আলোচনা করেন উপদেষ্টা সুমাইয়া হামিদ
ছবি: আনাস খান

গ্রন্থ আলোচনার শুরুতে উপদেষ্টা সুমাইয়া হামিদ লেখক সেলিনা হোসেনকে নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি জানান, সেলিনা হোসেন বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক, কথাসাহিত্যিক ও লেখক। তাঁর উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে সমকালের সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংকটের সামগ্রিকতা। বাঙালির অহংকার ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তাঁর লেখায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর লেখা। সেলিনা হোসেন কালজ্ঞ সত্যদ্রষ্টা। তাই ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসে আসে হলদী নদী, যুদ্ধদিনের বুড়ি ও রইস।

পাঠচক্র ও পাঠাগার সম্পাদক জান্নাতুল মিশু পাঠের আলোচনায় বলেন, ‘“হাঙর নদী গ্রেনেড” শুরু হয় বুড়ির শৈশব থেকে। বারো ভাই-বোনের মধ্যে একটি মেয়ে তার বাবাকে নাম বদলে দেওয়ার জন্য বলে। বুড়ির নামের এই প্রতিবাদ থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে নিজের সন্তানকে তুলে দেওয়া পর্যন্ত উপন্যাসটির পরিসর। হলদী গ্রাম যেন আমাদের বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। গ্রামের সামাজিক দৃশ্যপট সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখিকা।’

পাঠ আলোচনায় কার্যনির্বাহী সদস্য প্রিয়াংকা
ছবি: আনাস খান

কার্যনির্বাহী সদস্য প্রিয়াংকা গ্রন্থ আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘যুদ্ধের ঝড় আসে হলদীগাঁয়ে। সেই ঝড়ে ছিন্নভিন্ন হয় বুড়ির সাজানো সংসার। সলীম যায় যুদ্ধে। ভাই সলীম ও মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে খবর না দেওয়ায় কলীমকে পাকিস্তানি আর্মি ও তার দোসররা বুড়ির চোখের সামনে নির্মমভাবে খুন করে। যা দেখে বুড়ি বলে, “কলীম, তোর ঘাড়টা ঝুলে পড়েছে কেন? তুই একবার আমার দিকে চোখ তুলে তাকা। সাহসী বারুদ জ্বালা, দৃষ্টি ছড়িয়ে দে হলদীগাঁয়ের বুকে। মুছে যাক মহামারি, বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ। হলদীগাঁয়ের মাটি নতুন পলিমাটিতে ভরে উঠুক।” গল্পের শেষের দিকে আমরা দেখতে পাই, একজন মা ভাবছেন, তাঁর নিজের সন্তানের বিনিময়ে দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচিয়ে দিলে তিনি স্বাধীনতা পাবেন। বুড়ির মতো আরও হাজারো ত্যাগ-উৎসর্গের বিনিময়ে পেলাম আমাদের বিজয়, আমাদের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতাকে আমরা যেন অবমাননা না করি।’

শিক্ষার্থীরা আলোচনা থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নোট নিচ্ছে ও প্রশ্ন করছে। গ্রন্থ আলোচনার পর প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেয় রামিম সুলতানা, মনীষা, মরিয়ম আলসহ অন্য শিক্ষার্থীরা। পাঠচক্রের মাঝখানে ভেজা-শীতল হাওয়া এসে বৃষ্টির উপস্থিতি জানান দেয়, শুরু হয় তুমুল বর্ষণ আর বিদ্যুৎ চমকানো। প্রকৃতি যেন যুদ্ধদিনের ঝড়ের কথা জানাতে এসেছে। মোবাইলে ফ্ল্যাশ লাইটের আলো জ্বালিয়ে চলে পাঠের আসর।

বাংলাদেশ রেলওয়ে উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আজকের এই প্রযুক্তির যুগে ভৈরব বন্ধুসভার পাঠচক্র আলো ছড়াচ্ছে। দলগত প্রয়াসে ১৬৫তম পাঠের আসর করে ফেলা একটি বড় বিষয়।’ স্কুলটির প্রধান শিক্ষক মোক্তার হোসেন বলেন, ‘সবার আত্মত্যাগে আসে মুক্তিযুদ্ধ। দেশের একজন মায়ের নিজের সন্তানকে উৎসর্গ করা থেকে বর্তমান প্রজন্মের অনেক কিছু শেখার আছে। কাজ করতে হবে দেশের জন্য। ইচ্ছা ছিল পাঠচক্রটি হবে খোলা মাঠে, কিন্তু আবহাওয়া আমাদের পক্ষে ছিল না। পাঠচক্র ঘিরে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ আমাকে অভিভূত করেছে, ভৈরব বন্ধুসভাকে ধন্যবাদ।’

কুইজ বিজয়ীদের বই পুরস্কার দেওয়া হয়
ছবি: আনাস খান

ভৈরব বন্ধুসভার উপদেষ্টা ওয়াহিদা আমিন অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, ‘আমিও এই স্কুলের শিক্ষার্থী। কিন্তু আমাদের সময় বইপড়া নিয়ে এমন আয়োজন হয়নি। সেদিক থেকে তোমরা খুবই ভাগ্যবান।’ সভাপতি নাহিদ হোসাইন বলেন, ‘বইটির লেখক সেলিনা হোসেন কেবল সাহিত্যিক হিসেবেই নন, তিনি একজন প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মী, মানুষকে জাগ্রত করেন তাঁর কথা দিয়ে, লেখা দিয়ে। পৃথিবীর সব সফল মানুষের মধ্যে একটি বিষয় এক, সেটি হলো বই পড়া। বিল গেটস প্রতি মাসে তাঁর পড়া বইয়ের তালিকা প্রকাশ করেন। মাও সে-তুং বলেছেন, পড়ো পড়ো এবং পড়ো। কাজেই পড়তে হবে। বই পড়ার পাশাপাশি স্বপ্ন দেখতে হবে ভালো মানুষ হওয়ার।’

আলোচনায় আরও যুক্ত হন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক সুমন মোল্লা, কার্যনির্বাহী সদস্য ইকরাম বখশ, সাধারণ সম্পাদক রিফাত হোসেন, জেন্ডার ও সমতাবিষয়ক সম্পাদক তানশি নাহার। পরে সভাপতি নাহিদ হোসাইনের সঞ্চালনায় কুইজ পর্বের আয়োজন করা হয়। শিক্ষার্থীরা আগ্রহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে, পর্বটি বেশ জমজমাট হয়। কুইজ বিজয়ীরা হলো দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আল রাফি ও মনীষা এবং অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী নির্জন রহমান। বিজয়ীদের বই পুরস্কার দেওয়া হয়।

পাঠের আসরে আরও উপস্থিত ছিলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম, সহসাংগঠনিক সম্পাদক এরফান হোসেন, দুর্যোগ ও ত্রাণ সম্পাদক সাইফ রহমান, দপ্তর সম্পাদক আনাস খান, বন্ধু জিহাদ, প্রাপ্তি ঘোষ, সাদিয়া সরকার, হান্নান হিমু। পাঠের আসরটি ভৈরব বন্ধুসভার ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি প্রচারিত হয়।

সাধারণ সম্পাদক, ভৈরব বন্ধুসভা