‘বইদেয়াল’–এর সামনে বইপাঠের আসর

কিশোরগঞ্জ বন্ধুসভার পাঠের আসরছবি: বন্ধুসভা

কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের রকিব হাসান তাঁর বাড়ির সীমানাপ্রাচীর তৈরি করেছেন শেলফে রাখা বইয়ের সারির মতো করে। স্থানীয়ভাবে নান্দনিক এই সীমানাপ্রাচীর ‘বইদেয়াল’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। ভাষার মাস উপলক্ষে এই বইদেয়ালের সামনে বইপাঠের আয়োজন করেছে কিশোরগঞ্জ বন্ধুসভা। এতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক আনিসুল হকের লেখা ‘মা’ বইটি পাঠ করা হয়।

৯ ফেব্রুয়ারি বিকেলে উপজেলার সরারচরের কালেখাঁর ভান্ডা এলাকায় রকিব হাসানের বাড়ি ‘আনন্দধারা’র সামনে এ বই পাঠের আসর আয়োজন করা হয়। এ সময় বইদেয়ালবাড়ির মালিক রকিবুল হাসান, সমাজকর্মী জহিরুল ইসলাম, বন্ধুসভার উপদেষ্টা ফিরোজ কামাল, লুৎফুন্নেছা চিনু, সভাপতি মোস্তাফিজ মারুফ, সহসভাপতি রফিক আহমেদ সোবহানী, সাধারণ সম্পাদক নুসরাত জাহান, দপ্তর সম্পাদক তুষার ইমরান, দুর্যোগ ও ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক তায়্যিবা আফরোজ, স্বাস্থ্য ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক জিসান রিয়াজ, বন্ধু রাসেল আহমেদ, তিহাম বিন আজিজ, আহমদ শাহরিয়ার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। পাঠচক্রে ‘মা’ বইটির বিভিন্ন অংশ পাঠ করা হয়। সেই সঙ্গে বইদেয়াল গড়ার কারিগর রকিব হাসান তাঁর দেয়াল তৈরির গল্পটি বন্ধুসভার বন্ধুদের শোনান।

বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত শামছুল হক ভূঁইয়ার ছেলে রকিব বইপাগল মানুষ। ছয় ভাই-বোনের সবারই রয়েছে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা। তাঁদের বাবার ছিল বইয়ের প্রতি দারুণ অনুরাগ। বই পড়া ও জ্ঞানচর্চাকে উৎসাহ দিতেই বইয়ের দেয়াল গড়ার অভিনব উদ্যোগটি নেন রকিব। তাঁর বাড়িটি প্রায় ৪৭ শতাংশ জমির ওপর। বাড়ির সীমানাপ্রাচীরের বইদেয়ালটি ১০০ ফুট লম্বা ও প্রতিটি বইয়ের মোড়ক ১০ ফুটের মতো উঁচু। তবে সাজাতে গিয়ে কয়েকটি ৫ থেকে ৬ ইঞ্চি উঁচু-নিচু করা হয়েছে।

‘আনন্দধারা’ নামের দোতলা বাড়িটি নির্মাণের পর ২০২০ সালে বইয়ের সারির মতো করে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের কাজে হাত দেন রকিব। এক বছরের বেশি সময় ধরে কাজ চলে। ২০২৩ সালের প্রথম দিকে এই বইদেয়ালের কাজ সম্পন্ন হয়। এতে রকিবের ১০ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে বলে জানান। বইদেয়াল তৈরিতে প্রথমে ইট-পাথর দিয়ে প্রাচীরের কাঠামো তৈরি করে তার ওপর বসানো হয় স্টিলের পাত। যেখানে বুকশেলফের মতো করে সাঁটানো হয় বিভিন্ন বইয়ের মোড়ক। এই বইদেয়ালে স্টিলের পাতে তৈরি আনিসুল হকের লেখা ‘মা’ বইটিও রয়েছে। দেয়ালটি হুমায়ূন আহমেদের ‘তোমাদের জন্য রূপকথা’ দিয়ে শুরু আবু ইসহাকের ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ বই দিয়ে শেষ হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’, শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’, সমরেশ মজুমদারের ‘গর্ভধারিণী’, মরিস বুকাইলির ‘বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান’, জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’সহ কালজয়ী ৩৩টি বই।

বইদেয়াল
ছবি: বন্ধুসভা

রকিব হাসান প্রথম আলোকে জানান, ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার অভ্যাস তাঁর। একটি বই সংগ্রহ করে পড়তে তিনি মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন। কিন্তু ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি কারণে বর্তমান প্রজন্মের কাছে একধরনের বই বিমুখতা দেখা দিয়েছে। অথচ বই সারা জীবন বাতিঘর হয়ে পথ দেখিয়ে যায়। তাই নতুন প্রজন্মকে এসব বই পড়ার এবং বাঙালির জীবন ও সংগ্রামের ইতিহাস জানার প্রতি আগ্রহী করে গড়ে তোলার চেষ্টায় তিনি বইদেয়াল বাড়ি নির্মাণ করেছেন। তাঁর এই বাড়িতে প্রথম আলো বন্ধুসভার বন্ধুরা এসে পাঠচক্র করায় তিনি অত্যন্ত খুশি।

‘মা’ বইয়ের লেখক আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারও বাড়ির সামনের দেয়াল এভাবে বইয়ের মোড়কে সাজানো, সেটা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। এতে বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে।’

স্থানীয় শিবনাথ বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইয়াসমিন তাজরীন ও স্থানীয় বাসিন্দা স্বাধীন আহমেদসহ কয়েকজন বলেন, ৩৩টি পাঠকনন্দিত কালজয়ী বইয়ের মোড়ক শোভা পাচ্ছে সীমানাপ্রাচীরে। বাড়ির প্রাচীরটি দেখতে প্রতিদিন দূরদূরান্তের লোকজন ভিড় করছেন। রেললাইনের পাশে এ বইদেয়ালের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় ট্রেনে যেতে যেতেও। অভিনব বাড়িটি দেখে রকিবের সৃজনশীল চিন্তা ও রুচির প্রশংসা করছেন মানুষেরা। এ উদ্যোগ বইয়ের প্রতি সব শ্রেণির মানুষকে আগ্রহী করে তুলবে বলে বিশ্বাস তাঁদের।