রাতের বৃষ্টিতে শঙ্কা জেগেছিল অনুষ্ঠান ভালোভাবে সম্পন্ন হবে কি না। সকালের ঝলমলে রোদে সব শঙ্কা কেটে যায়। ১১ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় শিখো-প্রথম আলো জিপিএ-৫ কৃতী সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শুরুর কথা থাকলেও সাড়ে আটটা থেকে আসতে শুরু করে শিক্ষার্থীরা। সাড়ে নয়টার মধ্যেই অনুষ্ঠানস্থল চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের শহীদ সাটু অডিটরিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পেরে সবাই ছিল উচ্ছ্বসিত। শিক্ষার্থীরাই নেচেগেয়ে, আবৃত্তি করে অনুষ্ঠান মাতিয়ে রাখে।
খুব সকালে উঠে রওনা দিয়ে নাচোল উপজেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম হাকরইল থেকে মা সাবিনা সরেনকে নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হয় সিমতি মুর্মু। জেলা সদর থেকে প্রায় ৫০ কিমি দূর থেকে প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিনসহ অন্য সহপাঠীদের (জিপিএ -৫ পাওয়া) গোমস্তাপুর উপজেলার শ্যামপুর থেকে আসে আলিনগর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সারমিন খাতুন।
সকাল ১০টায় জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর ঢাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
স্বাগত বক্তব্য দেন চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আনোয়ার হোসেন। অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের উপাচার্য শফিকুল বারী, আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননার জন্য মনোনীত চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার আলীনগর বালিকা উচ্চবিদ্যালযের প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিন। কৃতী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বক্তব্য দেয় নাফিসা আক্তার, শাহাদৎ হোসেন। প্রথম আলো সম্পাদকের প্রতিনিধি হয়ে বক্তব্য দেন প্রথম আলোর নওগা প্রতিনিধি ওমর ফারুক। সঞ্চালনা করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ বন্ধুসভার সভাপতি আরাফাত মিলেনিয়াম।
বক্তব্য দিতে গিয়ে শফিকুল বারী বলেন, ‘এসএসসিতে সাফল্য অর্জন করা তোমাদের একটি স্বপ্ন দেখার প্রথম স্বীকৃত ধাপ। জীবনে স্বপ্ন দেখতে পারাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমি বাগেরহাটের সুন্দরবনঘেঁষা গ্রামের ছেলে। কুসুম নদীর তীরে বসে থাকতাম। অনেক বিদেশি জাহাজ আসা দেখতাম। একদিন গ্রিসের জাহাজ থেকে সাদা চামড়ার মানুষজন নেমে এসে আমাকে একটি চকলেট খেতে দিয়েছিল। এমন স্বাদের চকলেট আমি জীবনে খাইনি। সেই দিন মনে মনে ভেবেছিলাম, একদিন আমি গ্রিস যাব। সত্যি সত্যি আমি গ্রিসে গিয়ে লেখাপড়া করেছি। বিলেত যাওয়ার স্বপ্ন আমার পূরণ হয়েছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। সেটাও হতে পেরেছি। এরপর স্বপ্ন দেখেছি উপাচার্য হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাব। সেটাও শেষ পর্যন্ত হতে পারলাম। তোমরাও স্বপ্ন দেখো। স্বপ্ন পূরণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করো। তোমাদের স্বপ্নও সফল হবে।’
শিক্ষক মো. আলাউদ্দিন বলেন, ‘জীবনে উৎসাহ, প্রেরণা ও সম্মাননা পাওয়া খুবই কাজে লাগে। আমি ২০০৮ সালে প্রথম আলো আয়োজিত এসএসসিতে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিদ্যালয় থেকে একজন মাত্র ছাত্রীকে নিয়ে এসেছিলাম। প্রথম আলো ঢাকা অফিস থেকে আসা একজনের, আমি তাঁর নাম জানি না, বক্তব্য শুনে খুবই অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। এরপর বিদ্যালয়ে গিয়ে ছাত্রীরা অনুপ্রাণিত হয়, এমন কর্মসূচি গ্রহণ করি। এখন আমার বিদ্যালয়ে এসএসসিতে শতভাগ পাস হয়। কয়েক বছর থেকে ২০-২৫ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়। গত তিন বছর থেকে আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উপজেলায় এসএসসি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে আসছে। এবার জেলায় সর্বোচ্চ নম্বর (১২৬৪) পেয়েছে। আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম, এসএসসি পরীক্ষায় উপজেলায় যে সর্বোচ্চ নম্বর পাবে, তাকে পাঁচ হাজার টাকা দেব, সম্মাননা দেব। উপজেলায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়াদের পুরস্কৃত করেছি, সংবর্ধনা দিয়েছি। এবার জেলায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া ছাত্রীকে এলাকার অন্যান্য মানুষও টাকা দিয়েছে। পেয়েছে মোট ৩১ হাজার টাকা। সে রাজশাহী সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছে। তার ওপর আমাদের অনেক ভরসা। সে একদিন বিদ্যালয় নয়, গোটা এলাকার মুখ উজ্জ্বল করবে।’
প্রথম আলো নওগাঁ প্রতিনিধি ওমর ফারুক কৃতী শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন, তাদের বাবা-মা, শিক্ষক ও উপস্থিত অতিথিদের মাদক, মিথ্যা ও মুখস্থকে ‘না’ বলার শপথ করান।
অনুষ্ঠানে থিম সং-এ নাচ পরিবেশন করেন বন্ধুসভার পরিবেশ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক রাকিবুল হাসান ও বন্ধু রামিজ আহমেদ। কৃতীদের মধ্য থেকে কবিতা আবৃত্তি করে সুমা প্রামাণিক, মনিকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ বন্ধুসভার দপ্তর সম্পাদক আসেফ উৎস। নাচ পরিবেশন করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার কোল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ‘সীমার বাহা শিল্পী গোষ্ঠী’র শিল্পীরা এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ বন্ধুসভার বন্ধু অন্তর ও তৈনি। গান পরিবেশন করেন সালমা খাতুন, সাদিয়া তাসনিম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিল্পী আবু রিত্তিকা কনা। এ সময় শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজিত অনলাইন কুইজ প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের পুরস্কার হিসেবে বই উপহার দেওয়া হয়।
অর্থ সম্পাদক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ বন্ধুসভা