সুফিরা অন্তর্জগতের বিপ্লব ঘটিয়ে মানুষকে আলোকিত করে তোলেন

ড্যাফোডিল বন্ধুসভার ভার্চ্যুয়াল পাঠচক্র।

বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে সীমা বল এক আলোচিত নাম। কবিতা, গদ্য ও চিন্তামূলক রচনায় তাঁর অবস্থান আলাদা। তাঁর লেখায় যেমন আত্মজিজ্ঞাসার দীপ্তি, তেমনি থাকে জীবন ও সম্পর্কের প্রতি গভীর উপলব্ধি। তাঁর লেখা পাঠককে শুধু গল্প বা অভিজ্ঞতা দেয় না, বরং জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে শেখায়। যেখানে সুফিসাধকদের জীবন, ভাবনা ও আধ্যাত্মিক পথচলার দার্শনিক বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। লেখক সীমা বলের সুফি সৌরভ বই শুধু ধর্ম বা ইতিহাস নয়, বরং পাঠকের ভেতরের আলো খুঁজে পাওয়ার এক আমন্ত্রণ।

সুফি সৌরভ বইটি নিয়ে পাঠচক্রের আসর করেছে ড্যাফোডিল বন্ধুসভা। ২৫ জুন অনলাইন গুগল মিট অ্যাপে এটি অনুষ্ঠিত হয়। পাঠচক্রে আলোচক হিসেবে ছিলেন চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক শেখ বিবি কাউছার। তিনি বলেন, ‘একদিন সুলতান রাজসভায় একটি মূল্যবান রত্ন বের করে প্রধান উজির ও কোষাধ্যক্ষকে তা ভাঙতে বললেন। কিন্তু তারা কেউই সাহস করে না সেটি ভাঙার। পরে এক সাধারণ মেষপালক আয়াজকে একই আদেশ দেওয়া হলে, সে বিনা দ্বিধায় রত্নটি ভেঙে ফেলে। তখন সভাসদরা রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে সুলতান নিজেই আয়াজকে রক্ষা করেন। জিজ্ঞেস করেন, “এত দামি রত্ন ভাঙলে কেন?” আয়াজ শান্তভাবে বলে, “রত্নের চেয়ে আপনার আদেশ বড়।” সুলতান আবেগে আয়াজকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, “এই তো আমার প্রকৃত রত্ন, আমার আয়াজ”।’

সুফিবাদের মৌলিক দর্শন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শেখ বিবি কাউছার বলেন, ‘সত্যিকারের সুফিসাধক কখনোই জাগতিক মোহ, লোভ কিংবা খ্যাতির আকর্ষণে আবদ্ধ থাকেন না। তাঁরা দুনিয়াবি স্বার্থ, ভোগ-লালসা, ক্ষমতার প্রতিযোগিতা কিংবা অহংকারের চক্র থেকে নিজেদের সম্পূর্ণভাবে মুক্ত রাখেন। তাঁদের জীবন হয় নির্মোহ, নিঃস্বার্থ এবং একান্ত আত্ম-অভিমুখী।’

শেখ বিবি কাউছার আরও বলেন, ‘সুফিবাদের মূল সাধনা হলো অন্তরের অপবিত্রতাকে দূর করে আত্মাকে শুদ্ধ করা। একজন সুফিসাধককে অবশ্যই কামনা, ক্রোধ, হিংসা, বিদ্বেষ, অহংবোধ, লালসা, চাহিদা এবং পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার মতো সব মানবিক দুর্বলতার ঊর্ধ্বে উঠতে হয়। এ এক অন্তর্গত যুদ্ধ, যা বাহ্যিক শত্রুর সঙ্গে নয়, নিজের মনের গোপন আসক্তি ও দুর্বলতার বিরুদ্ধে। সুফিসাধকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয় বাহ্যিক ধর্মাচার বা আনুষ্ঠানিকতা—বরং সত্য, প্রেম, সহানুভূতি ও বিনয় তাঁদের মূল দর্শন।’

এই প্রসঙ্গে তিনি গভীর আবেগের সঙ্গে উল্লেখ করেন জালালউদ্দিন রুমি ও শামস তাবরিজের সম্পর্ক ও সাধনার কথা। শেখ বিবি কাউছার বলেন, ‘রুমি ও শামস ছিলেন আত্মিক সাধনার এমন দুই শিখর, যাঁদের জীবন-দর্শন ও পারস্পরিক সম্পর্ক সুফিবাদের এক অনন্য নিদর্শন হয়ে আছে।’

শামস তাবরিজ ছিলেন এক রহস্যময় দরবেশ, যিনি রুমির অন্তরের দরজা খুলে দিয়েছিলেন আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের পথে। রুমি তাঁর ভেতরে এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো শামসের প্রেম, প্রজ্ঞা ও আধ্যাত্মিকতা অনুভব করেছিলেন। সেই সম্পর্ক ছিল রূপক অর্থে স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির মিলন, আত্মার সঙ্গে আলোর ঐশ্বরিক সংলাপ। তাঁদের সম্পর্ক কোনো জাগতিক মেলবন্ধন নয়, ছিল এক নিবিড় আত্মিক বন্ধন—যেখানে প্রতিদিনের সাধনা, প্রেম, সংলাপ ও আত্মদর্শনের মাধ্যমে আত্মা হয়ে ওঠে বিশুদ্ধ, নির্মল ও স্রষ্টার প্রতি সমর্পিত।’

‘সুতরাং সুফিসাধক হওয়া মানে কেবল নির্জনে ধ্যান করা নয়—বরং প্রতিনিয়ত নিজেকে অতিক্রম করে চলা, নিজের মধ্যে এক নীরব বিপ্লব ঘটানো। সুফিরা বহির্বিশ্বের পরিবর্তন চান না, তাঁরা অন্তর্জগতের বিপ্লব ঘটিয়ে মানুষকে মানবিক, সহানুভূতিশীল ও আলোকিত করে তোলেন।’

বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত প্রবাহ ও অতি ব্যবহার তরুণ প্রজন্মকে এক অভূতপূর্ব সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে তিনি তরুণ সমাজকে সুফিবাদ ও আত্মসাধনার পথে আহ্বান জানান। শেখ বিবি কাউছারের মতে, প্রযুক্তি যেমন জীবনের নানা দিক সহজতর করেছে, তেমনি এটি মানুষের অন্তর্জগতের প্রশান্তি ও আত্মিক ভারসাম্যকে ক্ষয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে দিন দিন বাড়ছে অস্তিত্বসংকট, বিষণ্ণতা, আত্মহত্যার প্রবণতা, দীর্ঘসূত্রতা ও অপূর্ণতাবোধ। না-পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ও একধরনের অন্তর্গত শূন্যতা তাঁদের মানসিক জগতে এক ধ্বংসাত্মক অস্থিরতা তৈরি করছে। এই বাস্তবতায় সুফিবাদের আত্মশুদ্ধির দর্শন ও সাধনার চর্চা তরুণদের জন্য এক পরম আশ্রয় হতে পারে। সুফি সাধনা আত্মাকে আলোকিত করে, অন্তর্নিহিত শান্তি ও ভালোবাসার উৎস খুলে দেয়। তরুণদের মধ্যে যদি আত্মজিজ্ঞাসা ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনের চেতনা জাগ্রত করা যায়, তবে তাঁরা শুধু প্রযুক্তির দাস হয়ে থাকবে না, বরং এক পরিপূর্ণ, ভারসাম্যপূর্ণ ও কল্যাণমুখী জীবনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে। এই প্রেক্ষাপটে সুফিচিন্তা ও চর্চাকে তিনি সময়োপযোগী ও প্রাসঙ্গিক বলে মনে করেন এবং নতুন প্রজন্মকে এর তাৎপর্য অনুধাবনের আহ্বান জানান।

পাঠচক্রে যুক্ত ছিলেন ড্যাফোডিল বন্ধুসভার সভাপতি নাজমুল হাসান, সহসভাপতি ইনছান করিব, সাধারণ সম্পাদক জাকিয়া লিমা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অনিক ভূষণ সাহা ও অদ্বিত আল নাফিউ, অর্থ সম্পাদক ইমন হোসেন, সহসাংগঠনিক সম্পাদক শেখ আল মুসাব্বির, পাঠচক্র ও পাঠাগার সম্পাদক সালমান ফারসী, দুর্যোগ ও ত্রাণ সম্পাদক রিজভী আমিন, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি সম্পাদক মোস্তফা মাহফুজ, কার্যনির্বাহী সদস্য আবিদুর রহমানসহ আরও অনেকে।

বন্ধু, ড্যাফোডিল বন্ধুসভা