‘ওরা আমার চোখের সামনে এতগুলো মানুষকে হত্যা করেছে। আমাদের মা-বোনদের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। বালিয়াদীঘিতে ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় একজন সহযোদ্ধার কাছে শুনেছিলাম, তাঁর এলাকায় রাজাকাররা এক মাকে বলেছে, তোর কম বয়সী বেটিটাকে পাঞ্জাবিদের ওখানে পাঠা। ওদের খাবার রান্না করে দিবে; তাহলে তুই চালের বস্তা পাবি, ডাল, তেল এগুলো পাবি। ওই সহজ–সরল মা কিছু না বুঝে ছোট মেয়েকে পাঞ্জাবিদের ওখানে পাঠিয়েছেন। এভাবে করে কত মেয়ের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে ওরা।’
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণায় অশ্রুসিক্ত হয়ে কথাগুলো বলেন মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন। ২০ নভেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহনন্দা নদীর যাদুপুর খেয়াঘাটের পাড়ে টিনের ছাউনির গোলঘরে বসেছিল বন্ধুসভার উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার আসর। যুদ্ধের অভিযানে শত্রুর ঘেরাওয়ে পড়া, গুলিবিদ্ধ দুই সহযোদ্ধার মৃত্যু, শত্রুসেনার ছোড়া গুলি পায়ে বিদ্ধ হয়ে আহত হওয়া, ছত্রভঙ্গ হয়ে প্রাণ হাতে করে বন্যার পানি ভেঙে কৌশলে পালিয়ে আসার রোমাঞ্চকর গল্পসহ ১৯৭১ সালের বিভীষিকা, সাহস ও আত্মত্যাগের অনন্য কাহিনি আলোচনায় উঠে আসে।
দীর্ঘ ৩৮ বছর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন জয়নাল আবেদীন। ১৯৮৮ সালের ২৬ জুলাই অবসর গ্রহণ করেন। এই মুক্তিযোদ্ধা জানান, এপ্রিল মাস, দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে তাঁরা বালিয়াদীঘি ক্যাম্প থেকে সরে রাজশাহীর উপশহরের উইং সিক্সে যোগ দেন ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিনের অধীন। নাটোরের দিক থেকে আসা একের পর এক আর্টিলারি শেলের আঘাতে বাধ্য হয়ে পিছু হটতে হয়। রাইফেল হাতে তিনি অভয়া ব্রিজে অবস্থান নেন, আকাশ থেকে পাকিস্তানিরা বোমা ফেলায় দুই দিন যাদুপুরে আত্মগোপন করেন। পরবর্তী সময়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের মহদিপুর ক্যাম্পে আশ্রয় নেন এবং রায়গঞ্জ–কালিয়াগঞ্জ–শিলিগুড়ি হয়ে পুনরায় যুদ্ধে যোগ দেন।
বিএসএফের গাড়িতে করে বাংলাদেশ অভিমুখে রওনা হলে নিয়ামতপুর–নাচোল পেরিয়ে কৃষক সেজে ট্রেনে ওঠেন জয়নাল আবেদীন। ট্রেনে পাঞ্জাবি পাহারাদারের উপস্থিতিতে আত্মঘাতী পরিস্থিতির তৈরি হলেও সৌভাগ্যক্রমে সেদিন রেল চেকিং হয়নি। আমনুরা পৌঁছে সেখান থেকে ঘোড়ার গাড়িতে নয়াগোলা ঘাটের দিকে রওনা দিলে গাড়োয়ান প্রথমে পাঁচ টাকা ভাড়া চাইলেও মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় জানার পর বিনা ভাড়ায় নিরাপত্তাসহ পৌঁছে দেন।
বাসায় পৌঁছেই রাজাকারদের আতঙ্কে আবার পালিয়ে যেতে হয়। রামজীবনপুরে সহযোদ্ধার বাড়িতে আশ্রয় নেন। ফজরের সময় নদী পেরিয়ে আবার ভারতের মহদিপুর ক্যাম্পে পৌঁছান। সেখান থেকে ২৯ জনের একটি দল নিয়ে জমিনপুর–দাদনচক হয়ে বারোরশিয়া গ্রামে প্রবেশের প্রস্তুতি চলছিল।
ঠিক তখনই শুরু হয় গোলাগুলি। দাদনচকে পৌঁছাতেই সামনাসামনি ফায়ারের মুখে পড়েন তাঁরা। সহযোদ্ধা আনিসুরের বুকে গুলি লাগলে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। মাত্র ১৫ গজ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় মৃত্যুর ঠিক পূর্বমুহূর্তে আনিসুর তাঁর মাকে জানানোর কথা বলে যান। জয়নাল আবেদীন নিজেও হাত ও পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। বন্ধুসভার বন্ধুদের তিনি সেই গুলিবিদ্ধ ক্ষতের স্থান দেখান।
পরে কলেজের বুকসমান পানি পেরিয়ে মূল সড়কে পৌঁছাতে সক্ষম হন তাঁরা। আতঙ্কিত সহযোদ্ধাদের ভুল–বোঝাবুঝি থেকেও তাঁর দলের ওপর গুলি আসে। পরে মালদার সদলাপুর আমবাগানের অস্থায়ী হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা হয়। জয়নাল আবেদীনের কমান্ডার ছিলেন লে. আউয়াল, লে. গিয়াস এবং লে. জাহাঙ্গীর। দাদনচক কলেজে রয়েছে সহযোদ্ধা আনিসুর ও নাচোলের লতিফের জোড়া কবর।
বন্ধুসভার সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধার জীবন্ত স্মৃতিচারণা শুনে অভিভূত হন। জানান, স্বাধীনতার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা বীরদের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরাই ছিল এ আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য।
সভাপতি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ বন্ধুসভা