সুমন দাস (৪৩)। দিনাজপুর শহরের ব্যস্ততম মডার্ন মোড়, গণেশতলা সড়কের পাশেই ছোট জায়গায় বসে জুতা সেলাইয়ের কাজ করেন। রোদের তীব্রতা থামিয়ে দেয় কাজের গতি। তখন কাজ বন্ধ রেখে রোদের তেজ কমে গেলে সূর্যাস্তের পরে আবার শুরু হয় কাজ। দীর্ঘ বছর ধরে এভাবেই কাজ করে এলেও এবারের গরমকে আর উপেক্ষা করতে পারছেন না। কথা বলতে গিয়ে দেখা যায়, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কাঠের বাক্সে ঢুকিয়ে রওনা দিচ্ছেন বাড়ির উদ্দেশে। তিনি বলেন, ‘দুপুর ১২টা হইলেই আর রোদের চোটে এখানে থাকা যায় না। শেষ বেলায় আসি ৪টা বাজার পরে, যখন রোদের তেজ কম। যা রোজগার, কোনোরকমে চলে আরকি। ছাতা কিনব কিনব করে কিনা আর হয় না।’
দিনাজপুর বন্ধুসভার উদ্যোগে দেওয়া নতুন ছাতা পেয়ে সুমন দাসের রৌদ্রস্নাত পরিশ্রান্ত মুখে ফুটে ওঠে হাসির রেখা। ছাতার ছায়া, কাজকে আরেকটু সহজ করবে বলে আশাবাদী বন্ধুরা।
মহান মে দিবস, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। দিনটিকে ঘিরে আয়োজিত হয় নানা অনুষ্ঠান। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে দিনটিকে এবার ব্যাতিক্রমভাবে পালন করেছে দিনাজপুর বন্ধুসভা। ১ মে শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে মুচিদের সন্ধান করেন বন্ধুরা। প্রখর রোদে জরাজীর্ণ ছাতার নিচে বসে কাজ করা ১৫ জন মুচিকে নতুন ছাতা উপহার দেওয়া হয়। এ ছাড়া অন্তত ৪০ জন সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমিক, ভ্যান, রিকশা ও অটোরিকশা চালককে দেওয়া হয় একটি করে গামছা ও বিশুদ্ধ পানির বোতল।
ছাতা, পানির বোতল ও গামছা উপহার পেয়ে শংকর দাস (৪২) বলেন, ‘গাছের নিচেই বসি। সকালে রোদ থাকে না, বিকেলের রোদটা মুখে আসি লাগে, অভ্যাস হইছে। গরিব মানুষের কিসের রোদ। বৃষ্টি তো নামে নাই, এইবার এখনো অইজন্য ছাতাও কিনি না। আপনাদের উপহার খুব ভালো লাগল।’
শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে জুতা সেলাইয়ের কাজ করেন রতন দাস। এর আগে কেউ কখনো সেভাবে কিছু দেয়নি বলে জানান তিনি। বন্ধুদের দেওয়া ছাতা ও গামছা সানন্দে গ্রহণ করে ঘাড়ে জড়িয়ে নেন। এ ছাড়া ছাতা ও গামছা উপহার পান শহরের বাস টার্মিনাল, লিলিরমোড়, জেল রোড, নিমতলা ও সুইহারি এলাকার মুচিরা।
বয়স পঞ্চাশোর্ধ হলেও শরীরের জোর কমেনি ধীরেন্দ্রনাথের (৫৭)। এই বয়সেও কুঠার হাতে চিরছেন গাছের গুঁড়ি। কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে শহরের কালুর মোড়ে খড়ির কারখানায় খড়ি চেরার কাজ করেন তিনি। এই খড়ি চলে যায় ছাত্রছাত্রীদের মেসে। মে দিবস নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আইজ শ্রমিক দিবস বলে; কিন্তু কাজ বন্ধ থাকিলে খামো কী? তোমার জন্য অনেক আশীর্বাদ করি, বড় হও। মানুষের পাশে দাঁড়াও।’
বন্ধুদের উদ্দেশে প্রথম আলোর দিনাজপুর প্রতিনিধি শৈশব রাজু বলেন, ‘শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন আজ। চারদিকে নানাভাবে নানা আয়োজন চলছে, এর মধ্যে তোমাদের এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ প্রশংসনীয়। একটি ছাতা রোদ, বৃষ্টি—সব সময়ের প্রয়োজনীয় জিনিস। এভাবে মেহনতি সাধারণ মানুষদের পাশে থাকতে ভুলো না। এসবই আমাদের ভালো কাজের অংশ, এগুলোই আমাদের অর্জন। সবাইকে আজকের দিনটির শুভেচ্ছা।’
বন্ধু মুনিরা শাহানাজ চৌধুরী বলেন, ‘এই চিন্তাটা দারুণ, দিনটির তাৎপর্যের সঙ্গে সাধারণ মানুষকে একটি করে গামছা ও পানির বোতল পৌঁছে দিতে পারাটাও খুব আনন্দের বিষয়। আমরা শিক্ষার্থী, আমাদের সামর্থ অনুযায়ী যা করেছি খুবই চমৎকার। ধন্যবাদ দিনাজপুর বন্ধুসভাকে।’
কার্যক্রমে আরও উপস্থিত ছিলেন সভাপতি শুভ রায়, সহসভাপতি সুব্রত সরকার, প্রশিক্ষণ সম্পাদক বিপ্লব রায়, বন্ধু বিরোশ, স্বচ্ছ ও উৎস।
সভাপতি, দিনাজপুর বন্ধুসভা