মাতৃভাষা বাংলার প্রশ্নে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় কয়েকজন শহীদ হওয়ার দুই দিন পর খুলনায় মিছিল বের করেছিলেন নারীরা। ওই মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাজেদা আলী।
‘১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণের খবর রেডিওর মাধ্যমে জানতে পারলাম। কয়েকজন ছাত্র ভাইয়ের শহীদ হওয়ার প্রতিবাদে সারা দেশে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় খুলনায়ও মিছিল হবে। ছাত্রীদেরও মিছিল বের করার কথা ভাবলাম। প্রথমে কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিলাম। কারণ, এ ধরনের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। পরে বিএল কলেজের ছাত্রনেতা এম নুরুল ইসলামসহ অন্যদের কাছ থেকে কী করতে হবে, তা জেনে নিই।’
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এ কথাগুলো বলেন ভাষাসৈনিক বেগম মাজেদা আলী। একুশে ফেব্রুয়ারি বিকেলে মাজেদা আলীর বাসায় আড্ডা দিতে হাজির হন খুলনা বন্ধুসভার বন্ধুরা। হুইলচেয়ারে বসা মাজেদা আলীকে প্রথমে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়। পাশাপাশি খুলনা বন্ধুসভার পক্ষ থেকে একটি মগ স্মারক উপহার হিসেবে দেওয়া হয়।
মাতৃভাষা বাংলার প্রশ্নে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় কয়েকজন শহীদ হওয়ার দুই দিন পর খুলনায় মিছিল বের করেছিলেন নারীরা। ওই মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাজেদা আলী।
ওই দিনের মিছিলের কথা উল্লেখ করে মাজেদা আলী বলেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে কলেজ হোস্টেল থেকে বাইরে গিয়েছিলাম। তখন আমি আর কে গার্লস কলেজের (বর্তমানে বয়রা মহিলা কলেজ) ছাত্রী। আমাদের ক্লাস হতো বর্তমান করোনেশন স্কুল ভবনে। সন্ধ্যার দিকে হোস্টেলে ঢোকার সময় দেখি, গেটে মানুষ জড়ো হন। ছাত্রী থাকা অবস্থায় রেলওয়ে স্কুলে ক্লাস নেওয়ার সুবাদে শুধু আমিই হোস্টেল থেকে বের হতে পারতাম। তাই স্বাভাবিকভাবেই খোঁজ নিতে কলেজ গেটে বের হই। তখন বিএল কলেজের ছাত্রনেতা গাজী শহীদুল্লাহ, এম নুরুল ইসলাম, আবু মোহাম্মাদ ফেরদাউস, এ কে এম শামসুদ্দিনসহ বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে ঢাকার খবরটি জানতে পারি। আন্দোলনের প্ল্যাকার্ড তৈরির জন্য কিছু বড় সাদা কাগজ, লেখার জন্য কালির দোয়াত ও আলতা, কিছু হোগলার চাটাই, কিছু গরান কাঠের লম্বা ডাল এবং কী লিখতে হবে, তা ছোট কাগজে লিখে দিয়ে যান তাঁরা। ওই দিন রাত জেগে সুলতানা, সুফিয়া, পেয়ারা, জলি মিলে ব্যানার লিখি।’
‘পরদিন শুক্রবার। সারা দিন-রাত ছাত্রীদের বাড়ি গিয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করা হলো। পরিকল্পনা করা হলো কীভাবে সবাই একত্র হব। কীভাবে বিদ্যালয়ের গেটে তালা মারা হবে। কিন্তু সমস্যা হলো হোস্টেল থেকে এত ভোরে বের হব কী করে? হোস্টেলের চাবি থাকত দেবলা মাসির কাছে। দারোয়ান ছিলেন বচন মিয়া। করোনেশন বিদ্যালয়ের পেছনেই থাকতেন দেবলা মাসি। মেয়েরা সবাই মিলে দেবলা মাসির বাসায় গিয়ে বলল, “মাসি, তুমি কাল স্কুলে যাবা না। তোমার খুব জ্বর হয়েছে, বাসায় শুয়ে থাকবে। আর বচন মিয়া চাবি চাইলে বলবা, চাবি খুঁজে পাচ্ছি না। আমরা কাল বিদ্যালয় ও কলেজ বন্ধ রাখব। ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলি হয়েছে, তার প্রতিবাদে।” দেবলা মাসিকে বুঝিয়ে চাবি নিয়ে আসা হলো।’
উত্তাল সেই দিনগুলোর স্মৃতি এখনো পরিষ্কার বলে যান বেগম মাজেদা আলী। আবছা হয়ে যাওয়া তাঁর দৃষ্টির কি অপূর্ব দৃষ্টিপাত।
‘ভোরে হেস্টেলের পায়খানার পাশে ছোট গেট দিয়ে মেয়েরা বাইরে বের হয়েছিল। এরপর কয়েকজন মিলে কলেজ গেটে ছাত্রীদের জড়ো করতে থাকি। কাছে ব্যানার–ফেস্টুন থাকায় বাকি মেয়েরা হোস্টেল থেকে বের হয়নি। সকাল ৯টায় বাকি মেয়েরা বের হয়। এরপর মিছিল শুরু হয়। মিছিলে এক-দেড় শ ছাত্রী অংশ নেয়। মিছিলে স্লোগান দিয়েছিল খুকু, রত্না, কৃষ্ণাসহ অনেকে। মিছিলটি নিয়ে হাদীস পার্কের বাঁ দিকের একটি উঁচু মঞ্চে গিয়ে সমাবেশ করা হয়। এটিই ছিল ভাষা আন্দোলনে নারীদের প্রথম মিছিল খুলনায়,’ যোগ করেন এই ভাষাসংগ্রামী।
উত্তাল সেই দিনগুলোর স্মৃতি এখনো পরিষ্কার বলে যান বেগম মাজেদা আলী। আবছা হয়ে যাওয়া তাঁর দৃষ্টির কি অপূর্ব দৃষ্টিপাত। গল্পে গল্পে সেসব দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলেন আযম খান সরকারি কমার্স কলেজের সহযোগী অধ্যাপক কবি তারক চাঁদ ঢালী, প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শেখ আল এহসান, খুলনা বন্ধুসভার সভাপতি কাজী মাসুদুল আলম, সহসভাপতি এম এম মাসুম বিল্যাহ, সাধারণ সম্পাদক আসফিক আহমাদ সিদ্দীকী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফারজানা যূথি, অর্থসম্পাদক ইমন মিয়া, দপ্তর সম্পাদক তাসনিম নাহার, পাঠাগার ও পাঠচক্র সম্পাদক জুঁই আক্তার, বন্ধু সাম্মী আক্তার প্রমুখ।
বেগম মাজেদা আলীর বয়স বর্তমানে ৮৯ বছর। চোখে দেখতে পান না। তিনি খুলনা নগরের সুন্দরবন আদর্শ কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ। চার মেয়ে, নাতি–নাতনিদের নিয়েই সময় কাটে তাঁর। খুলনার ভাষাসৈনিকদের মধ্যে তিনিই কেবল বেঁচে আছেন। মাজেদা আলী জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলীর স্ত্রী।
বাংলা ভাষার প্রতি বেগম মাজেদা আলীর যে গভীর মায়া আর নতুন প্রজন্মের প্রতি ভাষাকে ধরে রাখার যে আকুতি, তা বারবার বাজছে হৃদয়ে। ইংরেজির আগ্রাসন থেকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে বলেছেন বাংলাকে লেখালেখির চর্চার মাধ্যমে। শুধু কি ইংরেজি, হিন্দির অতি ব্যবহারের ব্যাপারেও সতর্কতা খুবই দরকার!
সহসভাপতি, খুলনা বন্ধুসভা