নোয়াখালী মুক্ত দিবসে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনলেন বন্ধুরা

নোয়াখালী বন্ধুসভার বন্ধুদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক বাদলছবি: বন্ধুসভা

৭ ডিসেম্বর ছিল নোয়াখালী মুক্ত দিবস। এ উপলক্ষে জেলা প্রেসক্লাবে নোয়াখালী বন্ধুসভা আয়োজন করেছে স্মৃতিচারণামূলক বিশেষ সভা। অতিথি হিসেবে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক বাদল। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে নোয়াখালী জেলার কমান্ডার ইনচার্জ হিসেবে ছিলেন।

সভায় ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী এই মানুষটি যখন কথা বলছিলেন, তখন যেন ১৯৭১ সালের সেই ভয়াল দিনগুলো, কঠিন প্রশিক্ষণ ও মাতৃভূমি রক্ষার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া মুক্তিকামী বাঙালির আবেগ ও সাহসিকতার বীরত্বগাথা জীবন্ত হয়ে উঠল। তাঁর চমৎকার বাচনভঙ্গী উপস্থিত সবাইকে একমুহূর্তের জন্য ইতিহাসের উত্তাল সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

আলোচনার প্রারম্ভেই বন্ধুসভার সদস্যরা তাঁর কাছে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানতে চান। জবাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক অত্যন্ত সাবলীলভাবে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬ দফা, ১১ দফা, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতির মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি সুন্দর ধারাবাহিক বর্ণনা তুলে ধরেন।

সহসভাপতি জেরিন ফাহমিদা মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ব্যক্তিগত অংশগ্রহণের গল্প জানতে চাইলে উত্তরে উঠে আসে এক ভয়াবহ স্মৃতি। ফজলুল হক বাদল জানান, নোয়াখালী সদর উপজেলার সোনাপুরে পাকিস্তানি মিলিটারি কর্তৃক সংঘটিত এক নৃশংস গণহত্যা এই অঞ্চলের মানুষের মনে আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো প্রতিশোধস্পৃহা জাগিয়ে তুলেছিল। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই প্রাথমিকভাবে যুদ্ধে যেতে অনাগ্রহী মানুষজনও দলে দলে মাতৃভূমি রক্ষার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন।

মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে বন্ধুসভার সাংগঠনিক সম্পাদক সানি তামজীদ প্রশ্ন করলে অতিথি বক্তা ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় এক কোটি শরণার্থীর দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার বর্ণনা দেন। তাঁর বক্তব্য অনুসারে শরণার্থীশিবিরগুলোতে বিপুলসংখ্যক মানুষ শুধু কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল, যা যুদ্ধের সামগ্রিক বিভীষিকাকে আরও স্পষ্ট করে।

মুক্তিযুদ্ধে নোয়াখালীর মানুষের ভূমিকা এবং নারীদের অবদান নিয়ে জানতে চান সভাপতি উম্মে ফারহিন। উত্তরে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘যুদ্ধকালীন আমাদের মা-বোনেরা অতুলনীয় সাহায্য করেছেন। মুক্তিবাহিনী কারও কারও বাড়িতে একটানা ৭-১০ দিনও অবস্থান করতেন এবং মা-বোনেরা নিজের বাড়ির সদস্যের মতোই তাঁদের যত্ন নিতেন, নিরাপত্তা ও আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখতেন না। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে আমাদের নোয়াখালীর মানুষের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। তাঁরা একদম সম্মুখসারিতে থেকেই লড়াই করেছেন।’

এ ছাড়া আলোচনায় উঠে আসে আ স ম আব্দুর রব, শহীদ মুনীর চৌধুরী এবং নোয়াখালীর বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের গৌরবোজ্জ্বল নাম।

নোয়াখালী বন্ধুসভার বন্ধুদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক বাদল।

নোয়াখালীতে পাকিস্তানি মিলিটারিদের সঙ্গে কোনো সম্মুখযুদ্ধ হয়েছিল কি না? স্বাস্থ্য ও ক্রীড়া সম্পাদক নজরুল ইসলামের এমন প্রশ্নের উত্তরে মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক বাদল গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। কীভাবে ভারতে গিয়ে তিনি হ্যান্ড গ্রেনেড ও ৩৩ ক্যালিভারের বন্দুক চালনা শিখেছিলেন। নোয়াখালীর মুক্তিবাহিনী জেলার অভ্যন্তরে বেশ কিছু গেরিলা অপারেশন করে। এর মধ্যে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাটে তাঁদের দল রাস্তা আটকে পাকিস্তানি মিলিটারির একটি দলকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হয়। তার ছোট একটি ধারণা তিনি তুলে ধরেন।

স্মৃতিচারণার এক পর্যায়ে ফজলুল হক বাদল এমন কিছু সহযোদ্ধার কথা বলেন, যাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সূর্যোদয় দেখে যেতে পারেননি। তেমনি একজন ছিলেন ১৯৭০ সালের ডাকসুর সমাজকল্যাণ সম্পাদক এবং নোয়াখালী সদরের বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের (বিএলএফ) অধিনায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা ওহিদুর রহমান ওদুদ। ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার তাল মোহাম্মদের হাটে এক গেরিলা যুদ্ধে তিনি শহীদ হন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক বাদল বলেন, ‘এমন অসংখ্য আত্মত্যাগের বিনিময়েই আমরা আজকের এই স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছি।’

সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা সুমন নূর, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ধ্রুব ভূঁইয়া ও তাজকির হোসেন, অর্থ সম্পাদক তাসমিয়া ইয়াসমিন, পাঠাগার ও পাঠচক্র সম্পাদক শাহিদা রেশমি, বন্ধু ইমতিয়াজ দোলন, শাহরিয়ার, বোরহান উদ্দিনসহ আরও অনেকে।

প্রশিক্ষণ সম্পাদক, নোয়াখালী বন্ধুসভা