সংসারে দারিদ্র্য আর টানাপোড়েনের কারণে গ্রাম ছেড়ে দুই ভাই চলে আসেন ঢাকায়। সেখানে কাজ করেন একটি পোশাক কারখানায়। ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন তাঁরা। উত্তর বাড্ডার হোসেন মার্কেট এলাকায় একপর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হন দুই ভাই। এর মধ্যে বড় ভাই সোহাগ মিয়া (২৪) ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান। ছোট ভাই শুভ মিয়া (২০) গুরুতর আহত হন। এখনো পায়ে সেদিনের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
শহীদ সোহাগের পরিবারের খোঁজ নিতে গত ২১ অক্টোবর তাঁদের বাড়িতে যান সুনামগঞ্জ বন্ধুসভার বন্ধুরা। সোহাগের মা–বাবা, ভাই শুভ মিয়া ও তাঁর স্ত্রী এবং পরিবারের আরও দুই শিশুর জন্য পরিধানের নতুন কাপড়, শীতবস্ত্র এবং খাদ্যসামগ্রী নিয়ে যান তাঁরা। খুশি হন ওই পরিবারের সদস্যরা। প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একটি ভালো কাজের অংশ হিসেবে এ উদ্যোগ।
‘সোহাগডারে হারাইবার পরে তোমরার মতোন অনেকেই আইয়া দেইখ্যা যায়। মনের হাহাকার কিছুডা কমে। মনে কয় তোমরার মাঝেই আমার পুলাডা বাইচ্যা আছে।’বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত সোহাগ মিয়ার মা
নিহত সোহাগ মিয়ার বাড়ি সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার ভীমখালি ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের গোলামীপুর গ্রামে। জেলা শহর থেকে ওই গ্রামের দূরত্ব প্রায় ২২ কিলোমিটার।
গত সোমবার জেলা শহর থেকে সুনামগঞ্জ বন্ধুসভার উপদেষ্টা রাজু আহমেদ, বন্ধু প্রদীপ কুমার পাল, সভাপতি সৌরভ সরকার, সাধারণ সম্পাদক তাজকিরা হক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাকিরুল হক ওই গ্রামে সোহাগ মিয়ার বাড়িতে যান। বাড়িতে তখন বৃদ্ধ বাবা আবুল কালাম, মা রোকেয়া বেগমসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।
বন্ধুসভার পক্ষ থেকে বাবা আবুল কালামকে নতুন লুঙ্গি ও গেঞ্জি, মা রোকেয়া বেগমের জন্য শাড়ি, আহত শুভ মিয়ার জন্য শার্ট, তাঁর স্ত্রীর জন্য থ্রি–পিস, ঘরের সাত বছর ও তিন মাস বয়সী দুই কন্যাশিশুর জন্য দুটি জামা ও শীতবস্ত্র হিসেবে তিনটি কম্বল উপহার দেওয়া হয়। এ ছাড়া পরিবারের জন্য ছয় কেজি চাল, এক লিটার তেল, এক কেজি পেঁয়াজ, দুই কেজি আলু, এক কেজি চিনি, এক কেজি ডাল, নুডলস, মুড়ি, সুজি, চিপস, চানাচুর, বিস্কুটসহ নানা খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হয়। বন্ধুরা বেশ কিছু সময় তাঁদের বাড়িতে কাটান এবং সবিস্তারে পরিবারের খোঁজখবর নেন।
সুনামগঞ্জ বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক তাজকিরা হক বলেন, ‘শহীদ সোহাগ মিয়ার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে পেরে খুব ভালো লেগেছে। খুবই সহজ–সরল তাঁরা। এই কষ্টের মধ্যেও তাঁদের আন্তরিকতা মুগ্ধ করেছে। আমরা বলে এসেছি, যেকোনো প্রয়োজনে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ যেন করা হয়। প্রথম আলো বন্ধুসভা সব সময় ভালো কাজের সঙ্গে থাকে।’
বন্ধুসভার বন্ধুদের পাশে পেয়ে খুশি হন শহীদের বাবা আবুল কালাম। তিনি বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। পুলাডার রোজগারেই সংসার, আমার ওষুধের খরচ চলত। এখন কেডায় সংসার চালাইব। খুব কষ্টে আছি। মনের কষ্টডাও বেশি। আমার পুলাডা খুব ভালা মানুষ আছিল। সবথাইক্কা বেশি হেরই টান আছিল বাপ-মায়ের লাইগ্যা। পুলাডারে বিয়াও পর্যন্ত করাইতে পারলাম না। আল্লাহ পুলাডারে তাঁর ধারে লইয়া গেছেন।’ এই বলে তিনি চোখের জল মোছেন। তিনি আরও জানান, আহত শুভ মিয়ার পায়ে এখনো গুলির ক্ষত আছে। মাঝেমধ্যে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। তিনি ছেলের উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারের কাছে সাহায্য কামনা করেন।
মা রোকেয়া বেগম নিজে বন্ধুসভার বন্ধুদের আদর-আপ্যায়ন করেন। তাঁর ছেলে সোহাগ মিয়ার নিজের হাতে লাগানো কলাগাছের কলা সবাইকে খেতে দেন। চা-বিস্কুট দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করান। একপর্যায়ে মা রোকেয়া বলেন, ‘পুলাডার লাইগ্যা কানতে কানতে চোখের পানি শুকাই গেছে রে বাপধন। ওখন পুলার বয়সী কেউরে ধারেকাছে দেখলে শান্তি পাই। ঢাকাত থনে আইবার কালে হেরা শহর থাইক্যা কত কিছু লইয়া আইছে। বন্ধুরাও ফোন করলে তারার লাইগ্যাও লইয়া আইছে। এখন পুলাডা বাইচ্যা নাই। সোহাগডারে হারাইবার পরে তোমরার মতোন অনেকেই আইয়া দেইখ্যা যায়। মনের হাহাকার কিছুডা কমে। মনে কয় তোমরার মাঝেই আমার পুলাডা বাইচ্যা আছে।’
প্রতিবেশী ফারুক মিয়া বলেন, ‘প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ অনেকেই এসেছেন। দরিদ্র পরিবারটিকে সহায়তাও করেছেন। তাঁদের পাশে সমাজের সবার দাঁড়ানো উচিত।’
সোহাগের বাবা আবুল কালামের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁর পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে বড়, বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেদের মধ্যে সোহাগ মিয়া দ্বিতীয়। চার বছর আগে সোহাগ সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেন। এরপর জমি, ঘরের গরু আর মহাজনি সুদে ঋণ করে প্রায় চার লাখ টাকা জোগাড় করে দেন দালালকে। কিন্তু সব টাকা খোয়া যায়। এরপর সুদের টাকার চাপে ছোট ভাই শুভ মিয়াকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালান সোহাগ। ঢাকায় গিয়ে পোশাক কারখানায় কাজ নেন দুই ভাই। থাকতেন বাড্ডার হোসেন মার্কেট এলাকায়।
সভাপতি, সুনামগঞ্জ বন্ধুসভা