মৈমনসিংহ–গীতিকা বাংলা লোকসাহিত্যের এক অনন্য রত্নভান্ডার

অলংকরণ: আরাফাত করিম

মৈমনসিংহ-গীতিকা বাংলা লোকসাহিত্যের এক অনন্য রত্নভান্ডার। পূর্ব বাংলার ময়মনসিংহ অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত এই গীতিকা মূলত গ্রামীণ জীবনের আনন্দ–বেদনা, প্রেম–বিরহ, সামাজিক আচার অনুশাসন এবং মানুষের গভীর মানবিক অনুভূতিকে সুরে-ছন্দে প্রকাশ করে। এগুলো মূলত মৌখিক সাহিত্য, গ্রামীণ গায়েন, পালা গাইয়ে ও বাউল-ফকিরদের কণ্ঠে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়েছে।

মৈমনসিংহ গীতিকার বিখ্যাত কাহিনিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘মলুয়া’, ‘মহুয়ার পালা’, ‘দেওয়ান ভাতিন্দরীর পালা’, ‘চন্দ্রাবতী’, ‘কমলা’, ‘দশভুজা’, ‘ইরাকন্দরী’ ইত্যাদি। প্রেম, ত্যাগ, পরিবার, সমাজের রীতি সব মিলিয়ে এই কাহিনিগুলো একদিকে লোকজ কাব্যের শক্তিশালী রূপ, অন্যদিকে বাংলার অতীত সমাজজীবনের গুরুত্বপূর্ণ দলিল। ভাষার সহজতা, নাটকীয় বর্ণনা ও আবেগঘন উপস্থাপন গীতিকাগুলোকে বিশেষ জনপ্রিয়তা দিয়েছে।

ঊনবিংশ শতকে দীনেশচন্দ্র সেন এই গীতিকাগুলো সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সম্পাদনা করে সাহিত্যাঙ্গনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় গীতিকা প্রথমবার বই আকারে প্রকাশিত হয়ে দেশ-বিদেশে গবেষণার মূল্যবান উৎসে পরিণত হয়।

২৩ নভেম্বর বিকেলে মৈমনসিংহ-গীতিকা নিয়ে পাঠের আসর করে ময়মনসিংহ বন্ধুসভা। প্রথম আলো ময়মনসিংহ অফিসে এটি অনুষ্ঠিত হয়। পাঠচক্রে বন্ধু বোরহান উদ্দিনের সঞ্চালনায় বন্ধুরা মৈমনসিংহ-গীতিকার গল্প, ভাষা, লোকসংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা করেন। শুরুতে বন্ধুরা নিজ নিজ আত্মপরিচয় দেন।

স্বাগত বক্তব্যে সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেন, ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা আমাদের লোকসাহিত্যের প্রাণ। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষ, সমাজ, ইতিহাস ও আবেগের এক অনন্য দলিল। মৈমনসিংহ-গীতিকা নিয়ে এই আসর আমাদের নতুন করে ভাবতে, বুঝতে এবং নিজস্ব সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে অনুপ্রাণিত করবে এমনটাই বিশ্বাস করি।’

বন্ধু খাইরুল বাসার মৈমনসিংহ-গীতিকার মূল সারাংশ উপস্থাপন করে বলেন, ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা মূলত গ্রামীণ মানুষের জীবনের ছবি। এই গীতিকায় প্রেম-বিরহ, সংগ্রাম, ত্যাগ, পারিবারিক সম্পর্ক, সামাজিক রীতিনীতি এবং বিশেষ করে নারীর জীবনযন্ত্রণা অত্যন্ত বাস্তব ও আবেগঘনভাবে উঠে এসেছে। “মহুয়া” থেকে “মলুয়া”, “চন্দ্রাবতী” থেকে “কমলা’ প্রতিটি কাহিনির কেন্দ্রে রয়েছে মানবিক অনুভূতি ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই। গীতিকাগুলোর ভাষা সরল, কবিত্বময় ও শ্রুতিমধুর, যা শ্রোতার মনকে সহজেই স্পর্শ করে। এ ছাড়া এসব কাহিনি আমাদের স্থানীয় ইতিহাস, লোকসংস্কৃতি ও সমাজজীবন বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ উৎস। লোকগাথা হয়েও এগুলো বিশুদ্ধ সাহিত্যিক শক্তিতে ভরপুর, যা বাংলার লোককাব্যের এক অনন্য উচ্চতা নির্ধারণ করে।’

সভাপতি মোহাম্মদ খালিদ হাসান বলেন, ‘মৈমনসিংহ-গীতিকার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো লোকজ প্রাণশক্তি। বাংলা লোকসাহিত্যের ইতিহাসে এটি এক বিশাল সম্পদ। এগুলো লিখিত সাহিত্য নয়, গ্রামীণ মানুষের মুখে মুখে গড়ে ওঠায় ভাষা সরল, বর্ণনা সুরেলা এবং কাহিনি অত্যন্ত জীবন্ত। প্রেম, বেদনা, সংগ্রাম ও মানবিক সম্পর্ক এ গীতিকার মূল সুর। পাশাপাশি গ্রামীণ সমাজ সংস্কৃতি, নদী-নৌকার জীবন, লোকবিশ্বাস—সবই এতে বিদ্যমান। বিশিষ্ট গবেষক ড. দীনেশচন্দ্র সেনের সর্বাধিক অবদান রয়েছে মৈমনসিংহ-গীতিকায়। তিনি বিশ শতকের শুরুতে মানুষের মুখে মুখে থাকা কাহিনিগুলো সংগ্রহ করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। তাঁর প্রচেষ্টাতেই মৈমনসিংহ-গীতিকা বিশ্বসাহিত্যে স্বীকৃতি পায়।’

পাঠচক্রে আরও উপস্থিত ছিলেন দুর্যোগ ও ত্রাণ সম্পাদক তাওমান জাহান, বন্ধু অনিক চন্দ্র, আরিয়ান ইয়াছিন, ফারদিন হাসান, শাহাদাত হোসেনসহ অন্যরা।

সভাপতি, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা