‘যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হ’লো তার সাধ।’
জীবনানন্দ দাশের এই পঙ্ক্তিমালার সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের মনস্তাত্ত্বিক, রহস্যময় উপন্যাস ‘যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ’ যেন একই সূত্রে গাঁথা।
সকাল থেকেই টানা বৃষ্টি। মাঝেমধ্যে হাওয়া এসে বৃষ্টির বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। কাকভেজা হয়ে সবাই হাজির হলো সরকারি হাজী আসমত কলেজ প্রাঙ্গণের পাঠের আসরে। ২৬ সেপ্টেম্বর একঝাঁক তরুণকে নিয়ে পাঠচক্রের আসর করে ভৈরব বন্ধুসভা। ১৮৪তম পাঠের আসরের সঞ্চালক ছিলেন পাঠচক্র ও পাঠাগার সম্পাদক তানসি নাহার। এটি ছিল কলেজ পর্যায়ে তৃতীয় পাঠের আসর।
প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক সুমন মোল্লার শুভেচ্ছা বক্তব্যের মাধ্যমে আয়োজনের সূচনা হয়। তিনি বলেন, ‘মনের বিকাশ বাড়াতে মুদ্রিত বইয়ের বিকল্প নেই।’
‘হুমায়ূন আহমেদ সহজ সাবলীল ভাষায় লেখেন। নানা গুণে গুণান্বিত এই মানুষটি বাংলাদেশের সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। মজার ব্যাপার হলো, কয়েকবার তাঁর নাম পরিবর্তন করে হুমায়ূন আহমেদ রাখা হয়,’ গ্রন্থ আলোচনার শুরুতে এ কথা বলেন তানসি নাহার।
শিক্ষার্থী তনয় দেবনাথ যুক্ত করে বলে, হুমায়ূন আহমেদ তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ লিখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র থাকা অবস্থায়।
একটা মানুষ মারা তেমন কোনো জটিল বিষয় না। মৃত্যুর পর ডেডবডি কীভাবে লুকানো যায়, সেটাই সবচেয়ে জটিল ব্যাপার। নিজের স্ত্রী রুবাকে কীভাবে মারা যায়, সেটা নিয়ে মিজান চিন্তা করেছে এক মাস এবং মৃত্যুর পর কীভাবে গুম করবে, তা নিয়ে চিন্তা করেছে এক বছর। আমার ধারণা, মিজান স্বাভাবিক মানুষ নয়। তার ভেতর মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার রয়েছে। রুবাকে হত্যার পর একের পর এক হ্যালুসিনেশন ঘটতে থাকে মিজান সাহেবের সঙ্গে। কখনো মৃত রুবা পানি খেতে চায়, কখনো অন্যদের ফোন করে কথা বলে। একটা ঘোরের মধ্যে সময় কাটতে থাকে মিজান সাহেবের। গ্রন্থ আলোচনায় কথাগুলো বলেন ভৈরব বন্ধুসভার অর্থ সম্পাদক নাফিস রহমান।
স্ত্রীকে হত্যা করার মূল কারণ ছিল সন্দেহপ্রবণতা, যা মিজান সাহেবের মাথায় আসে বাসর রাতে। দুর্বল পুরুষেরা অন্যদের ওপর দায় চাপাতে ব্যস্ত থাকেন, সন্দেহের চোখে দেখেন। মিজান সাহেব একজন দুর্বল পুরুষ। উপন্যাসে দেখা যায় রুবা অনেক সুন্দরী মেয়ে, আধুনিকতার সব দিক তার মধ্যে ছিল। একজন প্রাণবন্ত মেয়ের দুরন্তপনা মিজান সাহেবের মনে সন্দেহের উঁকি দেয়। তিনি মনে করেন, তার স্ত্রী রুবা তাকে অবহেলা করে, সে রুবার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। বিন্দু বিন্দু করে জমা হয় ঈর্ষা, সেখান থেকে রাগ। তারপর হত্যা।
ভৈরব বন্ধুসভার সভাপতি প্রিয়াংকা গ্রন্থ আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘মিজান সাহেবের ছোটবেলা স্বাভাবিক ছিল না। জলাতঙ্ক রোগে মায়ের মৃত্যুর কয়েক দিন পর বাবাও মারা যান। শৈশব থেকে বঞ্চিত হওয়া মিজান সাহেব একধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত হন। নিঃসঙ্গ মিজান সাহেবের কোনো বন্ধু ছিল না, তিনি গল্প জমাতে পারেন না, গল্পের আসরেও যোগ দিতে চান না। বন্ধুদের সঙ্গে হাসাহাসি, কবিতা আবৃত্তি করা রুবাকে দেখলে মিজান সাহেবের হিংসা হয়। কারণ রুবার তুলনায় তিনি ছিলেন নিতান্তই সাধারণ মানুষ।’
রুবাকে হত্যার পর মিজানের ভয়ানক রকমের হ্যালুসিনেশন হয়। তার মনে পড়ে শৈশবের ভয়ংকর দিনগুলো। মিজান তার বাবাকে দেখতে পায়, তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে, রুবার পেটে বাচ্চা ছিল। মিজান তার বাবার কথামতো পুলিশকে খবর দিয়ে দোষ স্বীকার করে নেয়। যত্ন করে রুবাকে শাড়ি পরিয়ে বারান্দায় এসে দেখে চাঁদের ক্ষীণ আলো, এটাই কি রুবার সেই পঞ্চমীর চাঁদ? আজ রুবা এই চাঁদ দেখলে অনেক খুশি হতো। হয়তো জড়িয়ে ধরে মহসিন সাহেবকে বলত, ‘আমাদের ঘরে নতুন মেহমান আসবে।’
গ্রন্থ আলোচনায় আরও যুক্ত হন ভৈরব বন্ধুসভার উপদেষ্টা জনি আলম, সুমাইয়া হামিদসহ সরকারি হাজী আসমত কলেজের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা। কলেজের শিক্ষক লুবনা হক বলেন, ‘বইটির নামকরণ বেশ ভালো লেগেছে। সাহিত্যের দর্পণ হলো নামকরণ। পঞ্চমী তিথিতে চাঁদ ডুবে যাওয়া, রুবার কবিতা আবৃত্তিসহ সমগ্র বিষয়কে লেখক দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।’
বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান পান্না সুলতানা বলেন, ‘অস্বাভাবিক একটা মৃত্যুর উপন্যাস। হুমায়ূন আহমেদের ভিন্নধর্মী লেখা। বন্ধুসভা পাঠচক্রের মাধ্যমে তরুণদের পাঠাভ্যাস বাড়াচ্ছে।’
বইয়ের আলোচনা নিয়ে বিশ্লেষণ করেন শিক্ষক মোতাহার হোসেন, বরকত উল্লাহ পাঠান ও সাইফুর রহমান। গণিত বিভাগের প্রভাষক মোহাম্মদ সেলিম মিয়া বলেন, ‘পাঠচক্র আয়োজনে শুধু পাঠকই নয়, যারা মনোযোগ দিয়ে শোনেন তাদেরও জ্ঞান অর্জন হয়। এটাই পাঠচক্রের মাহাত্ম্য।’
গ্রন্থ আলোচনা শেষে মনোযোগী শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল কুইজ প্রতিযোগিতা। কুইজ পর্ব পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক মানিক আহমেদ। শিক্ষার্থীদের প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ পর্বটিকে জমজমাট করে তোলে। এই পর্বের বিজয়ীরা হলেন আসিফুর রহমান, ওজায়ের আহাম্মদ, তনয় দেবনাথ, সাব্বির আহমেদ ও হুজায়ফা হক। তাঁদের হাতে পুরস্কার হিসেবে তুলে দেওয়া হয় কিশোর আলো ম্যাগাজিন।
পাঠের আসরটি ভৈরব বন্ধুসভার ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। লাইভটি সমন্বয় করেন আনাস খান। পরবর্তী পাঠের আসরগুলো বসবে ভৈরবের আরও কয়েকটি কলেজে।
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা