দৃষ্টি আমাদের সঙ্গেই আছে

সিলেট বন্ধুসভার বন্ধু দৃষ্টি বর্মন স্মরণে শোকসভা ‘স্মরণে দৃষ্টি’
ছবি: শ্রেয়ান ঘোষ

সিলেট বন্ধুসভার বন্ধু দৃষ্টি বর্মন। সাহসী, প্রাণোচ্ছল, কর্মঠ ও আন্তরিক এই সদস্য পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন গত ১৫ সেপ্টেম্বর। তাঁর এভাবে চলে যাওয়া বন্ধুসভার প্রতিটি সদস্যের মধ্যে সৃষ্টি করেছে এক গভীর শূন্যতা। ‘স্মরণে দৃষ্টি’ শোকসভায় দেখা গেল সেটির ছাপ। উপস্থিত প্রতিটি সদস্যের চোখেমুখে ছিল শোক ও ভালোবাসার মিশ্র ছায়া।

৩১ অক্টোবর বিকেলে প্রথম আলো সিলেট অফিসের বন্ধুসভা কক্ষে অনুষ্ঠিত হয় এই শোকসভা। উপস্থিত ছিলেন সিলেট ও এমসি কলেজ বন্ধুসভা এবং দৃষ্টি বর্মনের পরিবারের সদস্যরা। সভাস্থলে দৃষ্টির একটি বড় ছবি ফ্রেমে সাজানো হয়, যার চারপাশে রাখা হয় তাঁর প্রিয় গোলাপ ফুল। সবাই ছবির চারপাশে গোল হয়ে বসে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।

একে একে বন্ধুরা দৃষ্টিকে নিয়ে তাঁদের স্মৃতিচারণা করেন। কেউ বলেন দৃষ্টির হাসির কথা, কেউ মনে করেন তাঁর কর্মনিষ্ঠা, কেউ–বা মনে করেন তাঁর উৎসাহ আর বন্ধুত্বের আন্তরিকতা। বন্ধু সমীর বৈষ্ণব বলেন, ‘দৃষ্টি ছোট বোনের মতো ছিল। ওর সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। ওর মৃত্যু আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। দৃষ্টিকে যখন শেষবিদায় দেওয়া হচ্ছিল, তখনকার সেই মুখটা এখনো চোখে ভাসে। ওর মৃত্যুর পর আমি অনেক দিন ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি।’

বন্ধু ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘দৃষ্টি আমার চোখের সামনেই এই পৃথিবী থেকে চলে যায়। যখন ও মারা যায়, আমি ছিলাম ওর পাশে। তিন দিন হাসপাতালে রাত-দিন ছিলাম। নিজের চোখে ওকে চলে যেতে দেখেছি। নিজেকে শক্ত রেখেছিলাম, কিন্তু পরে আর পারিনি। দৃষ্টি আমার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে।’

বন্ধু দেব রায় সৌমেন বলেন, ‘দৃষ্টি আমার ছোট বোন। গত বছর আমাকে ভাইফোঁটা দিয়েছিল এই বন্ধুসভার কক্ষেই। আর আজ সেই একই জায়গায় আমরা ওকে স্মরণ করছি। এটা বিশ্বাস করতে পারছি না যে দৃষ্টি নেই। আমি বিশ্বাস করি দৃষ্টি আমাদের সঙ্গেই আছে। ওর কাজ, ওর ভালোবাসা, ওর হাসি— সবকিছুই ওকে আজীবন বাঁচিয়ে রাখবে।’

বন্ধু শ্রেয়ান ঘোষ বলেন, ‘ভাবতেই অবাক লাগে— এত প্রাণোচ্ছল, আন্তরিক একজন মানুষ আমাদের মধ্যে নেই। ভেবেছিলাম দৃষ্টি দি শেষ পর্যন্ত জীবনের সঙ্গে যুদ্ধে জিতে ফিরবে, কিন্তু তা আর হলো না। সব সময় দেখেছি, দৃষ্টি দি যেকোনো কাজে সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়ত। কোনো কাজে কখনো না বলতে শুনিনি। ঈশ্বর হয়তো ভালো মানুষগুলোকেই আগে তাঁর কাছে নিয়ে নেন।’

সিলেট বন্ধুসভার বন্ধু দৃষ্টি বর্মন স্মরণে শোকসভা ‘স্মরণে দৃষ্টি’
ছবি: শ্রেয়ান ঘোষ

শোকসভায় উপস্থিত ছিলেন সিলেটের সাংস্কৃতিক কর্মী এবং বন্ধুসভার শুভাকাঙ্ক্ষী মামুন পারভেজ। তিনি বলেন, ‘দৃষ্টিকে আমি প্রথম দেখি প্রথমা বুক ক্যাফেতে। ওর হাতে ছিল গিটার। কত প্রাণোচ্ছল আর আন্তরিক একটা মেয়ে! আজ এখানে উপস্থিত প্রত্যেকটা মানুষ দৃষ্টির জন্য এসেছে, দৃষ্টিকে নিয়ে কথা বলছে। সবার সঙ্গেই ওর কোনো না কোনো স্মৃতি আছে। এতেই বোঝা যায় মেয়েটি কতটা কর্মঠ, আন্তরিক আর প্রিয় ছিল। দৃষ্টি বেঁচে থাকুক ওর কাজের মধ্য দিয়ে।’

সিলেট প্রথম আলোর ব্যুরো প্রধান সুমন কুমার দাস বলেন, ‘অনেক খারাপ লাগছে যে এ রকম সাহসী ও কর্মঠ একজন সদস্য হারাল সিলেট বন্ধুসভা। দৃষ্টি বর্মন নামটা সিলেট বন্ধুসভা সব সময় মনে রাখবে। ও বেঁচে থাকুক সব বন্ধুদের মধ্যে।’

এ সময় দৃষ্টি বর্মনের দিদি ও বন্ধুসভার সদস্য গায়ত্রী বর্মন কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘দৃষ্টি শুধু বোন নয়, ও ছিল আমার বন্ধুও। ওর হাসি, ওর কাজের প্রতি ভালোবাসা, বন্ধুসভার প্রতি দায়িত্ববোধ—এসবই ওকে আলাদা করে চিনিয়ে দিত। আমি বিশ্বাস করি, দৃষ্টি আমাদের সবার মধ্যেই রয়ে গেছে।’

দৃষ্টির আত্মীয়স্বজনেরাও স্মৃতিচারণা করেন। বন্ধুসভার প্রতিটি সদস্যই কোনো না কোনোভাবে দৃষ্টির কথা বলেন— কেউ চোখের জল ফেলেন, কেউ মৃদু হাসেন, কেউ নীরবে চেয়ে থাকেন তাঁর ছবির দিকে। শেষে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর সবাই একসঙ্গে গেয়ে ওঠেন ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ গানটি— যেন দৃষ্টির প্রতি এক সংগীতময় শ্রদ্ধাঞ্জলি।

সন্ধ্যা ছয়টায় শেষ হয় শোকসভা। পুরো অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা করেন বন্ধু সূবর্ণা দেব।