মুক্তিযুদ্ধ থেকে সংস্কৃতির মঞ্চে— ভবতোষ রায় বর্মণের গল্প

বীর মুক্তিযোদ্ধা ভবতোষ রায় বর্মণের সঙ্গে শাবিপ্রবি বন্ধুসভার বন্ধুদের সাক্ষাৎছবি: বন্ধুসভা

মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা, সিলেট মহানগর মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডের সাবেক কমান্ডার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ভবতোষ রায় বর্মণ ১৯৫০ সালের ২ সেপ্টেম্বর সিলেটের রামের দিঘিরপাড় গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সংস্কৃতিমনা পরিবারের সন্তান। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে ভবতোষ রায় বর্মণ সবার বড়। পরিবার ও কাছের মানুষেরা স্নেহভরে তাঁকে ‘রানা’ নামে ডাকেন। তাঁর বাবা স্বর্গীয় ভারতচন্দ্র রায় বর্মণ ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী, মা স্বর্গীয়া চন্দ্রাবতী রায় বর্মণ ছিলেন লোকগীতি শিল্পী। মায়ের প্রতি ভবতোষ রায় বর্মণের ছিল গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।

দেশপ্রেম ভবতোষ রায় বর্মণের রক্তে মিশে আছে। নিশ্বাসের মতোই তিনি মাতৃভূমিকে ভালোবাসেন, কখনো ভুলে যান না। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বারবার ফিরে যান সেই অগ্নিঝরা ১৯৭১ সালে।

১৯৬৭ সালে ভবতোষ রায় বর্মণ সড়ক ও জনপথ বিভাগে চাকরিতে যোগ দেন। এরপরই শুরু হয় দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মুক্তির সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তিনি সিলেটে অনুষ্ঠিত বিশাল লাঠিমিছিলে অংশ নেন। সরকারি চাকরিজীবী হয়েও দেশের ডাকে সাড়া দিতে দ্বিধা করেননি। মিছিলের পর থেকেই সিলেট নগরের আকাশে ভেসে বেড়াতে থাকে গুলির শব্দ। একসময় তাঁর বাড়ির আশপাশে টান টান উত্তেজনা বিরাজ করে। পাকিস্তানিদের সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কায় পরিবার নিয়ে টানা দুই দিন খাটের নিচে আশ্রয় নেন। চুলা জ্বালানো নিষিদ্ধ, শিশুর কান্নাও স্তব্ধ, চারদিক নিস্তব্ধতায় ঢেকে গিয়েছিল।

পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠলে জামালগঞ্জ থেকে বালাট সীমান্ত পেরিয়ে পরিবারসহ ভারতে আশ্রয় নেন। সেখানেই মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে নাম লেখান ভবতোষ রায় বর্মণ। ৩৫ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে ক্যাপ্টেন রাওয়ের নেতৃত্বে ৩৫ সদস্যের একটি দলে তামাবিল সীমান্ত ক্যাম্পে যোগদান করেন।

যুদ্ধের ময়দানে তিনি মৃত্যুকে তোয়াক্কা না করে লড়েছেন প্রাণপণে। গুলির ধোঁয়া ও ধুলার আস্তরণে তখন তাঁর মুখ চেনাই কঠিন ছিল। এক অভিযানে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাকে বন্দী করার পর এক সহযোদ্ধার রাইফেল থেকে ভুলবশত গুলি ছুটে গেলে অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচেন।

গত ৭ অক্টোবর শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার বন্ধুরা বীর মুক্তিযোদ্ধা ভবতোষ রায় বর্মণের কাছে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে। এ সময় ওনাকে নিয়ে একটি ভিডিও প্রতিবেদন নির্মাণ করেন তাঁরা।

ভবতোষ রায় বর্মণ জানান, দেশ স্বাধীন হয় ১৬ ডিসেম্বর, কিন্তু সিলেট মুক্ত হয় ১৭ ডিসেম্বর। কারণ, তখনো পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করেনি। বিজয়ের আগের রাতে বিমানবন্দর এলাকায় তুমুল লড়াই চলে। এক সহযোদ্ধা সেদিন গুলিতে শহীদ হন। অবশেষে পরদিন সিলেটও দখলদারমুক্ত মুক্ত হয়। তিনি ১৯৭১ সালের ২৪ ডিসেম্বর অস্ত্র জমা দেন এবং ২৬ ডিসেম্বর আবারও চাকরিতে যোগদান করেন।

দীর্ঘ সরকারি চাকরিজীবন শেষে ২০১৪ সালে অবসর নেন। বর্তমানে তিনি সিলেট শিল্পকলা একাডেমিতে প্রশিক্ষক হিসেবে যুক্ত আছেন। সাদাসিধে, সাধারণ জীবন নিয়েই তিনি তৃপ্ত ও শান্ত। ভবতোষ রায় বর্মণ চান, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারে এবং তা সংরক্ষণে উদ্যোগী হয়। তাঁর ভাষায়, ‘এই স্মৃতিগুলো হারিয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধারাও হারিয়ে যাবেন, আসল ইতিহাসটাও কেউ জানবে না।’

সিলেট মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক এই কমান্ডার তাঁর যুদ্ধজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের জলছবি ১৯৭১’ শিরোনামে লিখেছেন একটি বই। বইটিতে তুলে ধরেছেন যুদ্ধের ভেতরকার আবেগ, বেদনা ও বীরত্বগাথা; যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এক মূল্যবান দলিল। তিনি বইটি শাবিপ্রবি বন্ধুসভার বন্ধুদের উপহার হিসেবে দেন।

ভিডিও প্রতিবেদন সঞ্চালনা করেন বন্ধু শাকিল হাসান। পরিকল্পনা, পরিচালনা এবং ক্যামেরা সহযোগিতায় ছিলেন বন্ধু শাফিনুর ইসলাম ও সাবিনা আক্তার। ভিডিও প্রতিবেদনটি শিগগিরই শাবিপ্রবি বন্ধুসভার ফেসবুক পেজে সম্প্রচার করা হবে।