‘গণিত ছাড়া পৃথিবী অচল’

রাজশাহী আঞ্চলিক গণিত উৎসবে পরীক্ষা দিচ্ছে শিক্ষার্থীরাছবি: বন্ধুসভা

মাঘের সকালের কুয়াশাজড়ানো শীতে অভিভাবকেরা বসে অপেক্ষা করছিলেন সন্তানদের জন্য। সবাই চেয়ে আছেন সন্তানেরা পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে কী বলবে, সেই আশায়। এভাবেই দেশকে বিশ্বমানের করতে গণিতকে জয় করার প্রত্যাশায় রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ৬৭১ খুদে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত হলো আঞ্চলিক গণিত উৎসব–২০২৫।

‘গণিত শেখো, স্বপ্ন দেখো’ স্লোগানে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় এই উৎসবে সার্বিক সহযোগিতা করেন রাজশাহী বন্ধুসভা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার বন্ধুরা। ১৮ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৯টায় রাজশাহী নগরের শাহ্ মখদুম কলেজ মাঠে এটি অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় সংগীতের সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড পতাকা ও আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে উৎসব শুরু হয়। উদ্বোধন করেন শাহ্ মখদুম কলেজের অধ্যক্ষ এস এম রেজাউল ইসলাম।

সকাল ১০টায় পরীক্ষা শুরু হয়। এক ঘণ্টার পরীক্ষা শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন বাংলাদেশ জাতীয় অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ, আহ্ছানিয়া মিশন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদের ডিন অধ্যাপক ইকবাল মতিন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক খাদেমুল ইসলাম, রাজশাহী কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আলাউদ্দিন, রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজের গণিত বিভাগের শিক্ষক সেলিনা আক্তার, রাজশাহী আহ্ছানিয়া মিশন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক জোবায়ের হোসাইন ও রাজশাহী ম্যাথ ক্লাবের সভাপতি মাসুদ রানা।

এই পর্বে শিক্ষার্থীরা মজার মজার প্রশ্ন করে পুরস্কার জিতে নেয়। পুরস্কার হিসেবে তাদের হাতে বিজ্ঞানচিন্তা ও কিশোর আলো ম্যাগাজিন তুলে দেন অতিথিরা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী দীপ্ত মজুমদারের প্রশ্ন ছিল ‘সূর্যের আসল রং কোনটা?’ এ ছাড়া সে কায়কোবাদ স্যারের একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েও পুরস্কার জিতে নেয়। একইভাবে রাজশাহী ল্যাবরেটরি স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফারহান ইসলাম, শিমুল মেমোরিয়াল নর্থসাউথ স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির আলফি শাহরিন, নাটোরের আহমদপুর এম এইচ উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির আব্দুল্লাহ আল নাসিম, নওগাঁ সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির তাসমিয়া জান্নাতসহ অনেকেই পুরস্কার পায়। এরপর রুবিকস কিউব প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জেতে আরও তিন শিক্ষার্থী।

রাজশাহী আঞ্চলিক গণিত উৎসবে গণিত নিয়ে প্রশ্ন করছে এক শিক্ষার্থী
ছবি: বন্ধুসভা

অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত করতে হলে আমাদের জ্ঞানবিজ্ঞানের দক্ষতায় বলীয়ান হতে হবে। রাজশাহী থেকে গিয়ে ঢাকা জয় করে আনতে হবে। রাজশাহীতে অনেক ভালো ছেলেমেয়ে আছে, যারা অতীতে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। রাজশাহীর ফারহান আহমেদ এমআইটিতে চান্স পেয়েছে। আমরা চাই, তোমরাও সেই সুযোগ পাও।’

ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের রাজশাহী শাখার ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বড় হতে হলে অন্যদের সম্মান দিয়ে হতে হবে, অন্যকে ছোট করে বড় হওয়া যাবে না। বিনয়ী হতে হবে। এখান থেকে জাতীয় পর্যায়ে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গিয়ে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘ডাচ্-বাংলা ব্যাংক সম্ভাবনায় উদ্ভাসিত একটি ব্যাংক। তারা সামাজিক দায়িত্ব থেকে যে কর্মকাণ্ড করে, তারই একটি হচ্ছে গণিত অলিম্পিয়াড। আশা করি, যে উদ্দেশ্যে গণিত উৎসবের আয়োজন করা হয়, তার সাফল্য যেন শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে উঠে আসে।’

অধ্যাপক ইকবাল মতিন বলেন, ‘গণিতই সব শিক্ষার বনিয়াদ।’ এ সময় তিনি বেহালায় একটি রবীন্দ্রসংগীতের সুর বাজিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করেন, ‘বেহালার সঙ্গে গণিতের কী সম্পর্ক আছে, তোমাদের বের করতে হবে।’

অধ্যাপক খাদিমুল ইসলাম বলেন, গণিত ছাড়া পৃথিবী অচল। তিনি আফসোস করে বলেন, ‘আমাদের সময়ে কেন এই উৎসব ছিল না।’
অধ্যাপক আলাউদ্দিন বলেন, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের উন্নতি করতে হলে গণিত শিখতে হবে।

জাতীয় পর্বের জন্য নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুসভার বন্ধুরা
ছবি: বন্ধুসভা

গণিত অলিম্পিয়াডের কাউন্সিলর জ্যোতি সিংহ বলেন, ‘গণিত শিখো, গণিতকে ভালোবাসো। সত্যিকারেই তোমরা যেটা জানতে চাও, এমন প্রশ্ন করবে। জীবনমুখী শিক্ষাটা অনেক বেশি দরকার। সব জায়গায় জিততে হবে, এমন কোনো কথা নেই। আমরা যেন নতুন কিছু শিখতে পারি, এটাই আমাদের প্রত্যয় হোক। আজ যারা ঢাকায় যাওয়ার জন্য নির্বাচিত হতে পারবে না, তারা মন খারাপ করবে না। আগামী দিনে আরও অন্য কোনো অলিম্পিয়াডে তোমরা জয়ী হবে। না হলেও স্কুলে ভালো করবে। শুধু মনে রাখবে, তোমরা যা করবে ভালোবেসে করবে।’

রাজশাহী আঞ্চলিক গণিত উৎসব থেকে প্রাইমারি ক্যাটাগরিতে ১১ জন, জুনিয়র ক্যাটাগরিতে ২২, সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে ১১ ও হায়ার সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে ৬ জনকে জাতীয় পর্যায়ের জন্য নির্বাচিত করা হয়। ফলাফল প্রকাশের পর নির্বাচিতদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন অতিথিরা।

সমাপনী বক্তব্য দেন রাজশাহী বন্ধুসভার সভাপতি মিজানুর রহমান। উৎসবে জাতীয় সংগীত ও ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গানটি পরিবেশন করেন রাজশাহী বন্ধুসভার বন্ধুরা। সঞ্চালক রাজশাহী বন্ধুসভার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাদিকা সোনালী ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক নাহিদ হাসান শিক্ষার্থীদের মিথ্যা, মুখস্থ ও মাদককে ‘না’ বলার শপথ করান।

সহসভাপতি, রাজশাহী বন্ধুসভা