‘বর্ণমালার প্রতিও আমাদের যত্নশীল হতে হবে’

বাংলা ভাষার তাৎপর্য নিয়ে ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার আয়োজনছবি: বন্ধুসভা

বাংলা ভাষা চিরদিনই শোষিত শ্রেণির ভাষা। বাংলা ভাষা আপামর জনসাধারণের ভাষা। আদি যুগ থেকেই এই অঞ্চলের ভাষাকে শাসকশ্রেণি কখনো মর্যাদা দিতে চায়নি। শাসকের ভাষার সঙ্গে সব সময় একটা শ্রেণির দ্বন্দ্ব ছিল। দরবারের ভাষা কখনো ফারসি, সংস্কৃত, কখনো–বা ইংরেজি হয়েছে; কিন্তু কখনো বাংলা হয়নি। শাসক ও শোষকের মধ্যে যে শ্রেণিসংগ্রাম, তা ভাষার রূপ ধরেই আমাদের মধ্যে এসেছে। সাধারণ মানুষ কখনো শাসকের ভাষাকে মেনে নেননি।

২৪ ফেব্রুয়ারি ‘মোদের গরব, মোদের আশা/আ–মরি বাংলা ভাষা!’ প্রতিপাদ্যে বাংলা ভাষার তাৎপর্য নিয়ে ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন কবি ও সাংবাদিক শান্তা মারিয়া। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের প্রথম আলো কার্যালয়ের ১০ তলার সভাকক্ষে এটি অনুষ্ঠিত হয়। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় শুরু হয়ে অনুষ্ঠান চলে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত।

অতিথিদের বন্ধুসভার পক্ষ থেকে বই উপহার দেওয়া হয়
ছবি: বন্ধুসভা

মাতৃভাষাকে অমর্যাদা করার প্রতিবাদেই ভাষা আন্দোলন উল্লেখ করে কবি ও সাংবাদিক শান্তা মারিয়া বলেন, ‘বাংলার সঙ্গে অন্য ভাষা মিশ্রিত করে কথা বললে নিজের পাণ্ডিত্য প্রকাশ পায় না। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ২৮টি ভাষা জানতেন। কিন্তু কথা বলার সময় প্রমিত বাংলায় কথা বলতেন। ভাষার মিশ্রণের প্রতিবাদ আমাদের এখনকার ভাষা আন্দোলন।’ রোমান হরফে বাংলা লিখতে থাকলে একসময় আমাদের বর্ণমালা হারিয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘বাংলা ভাষার পাশাপাশি বাংলা লিপির বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র হয়েছে বিভিন্ন সময়। বর্ণমালার প্রতিও আমাদের যত্নশীল হতে হবে।’ সাংবাদিক শান্তা মারিয়া সম্পর্কে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নাতনি, ভাষাসৈনিক মুহম্মদ তকীউল্লাহর মেয়ে ও ভাষাসৈনিক মুর্তজা বশীরের ভাতিজি।

শুরুতেই একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নেন বন্ধুরা। উপস্থিত ছিলেন বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ, ঢাকা মহানগর, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ক্যামব্রিয়ান কলেজ, মিরপুরসহ ঢাকার বিভিন্ন বন্ধুসভার অন্তত ৬০ বন্ধু। সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর ভাষাশহীদদের স্মরণে মোমবাতি প্রজ্বালন ও তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এ সময় সমবেত কণ্ঠে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গান পরিবেশন করেন বন্ধুরা।

সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনা
ছবি: বন্ধুসভা

শুভেচ্ছা বক্তব্যে ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার সভাপতি সাইদুল হাসান বলেন, ‘১৯৪৮ সালে পৃথিবীর মানচিত্রে ভারতবর্ষে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তে রঞ্জিত হলো পৃথিবীর মাটি। সে মাটি আমার বাংলার। যে মাটির ঘ্রাণে পাগল হয়েছে ওলন্দাজ, গোলন্দাজ, ডাচ, ফরাসি, মোগল, পাঠান, ইংরেজসহ অনেক জাতি। সেই উর্বর মৃত্তিকা সিক্ত হলো সালাম, শফিক, রফিক, বরকত, জব্বার, ওহিউল্লাহসহ অনেকের তাজা রক্তে। তাঁদের রক্তের বুননে আজ আমার শিশুর চিৎকার ‘‘মা’’। আমার প্রাণের ভাষা বাংলা আমার আত্মা থেকে বড় পবিত্রতায় উচ্চারিত হয় সারা পৃথিবীময় অ আ ক খ।’

বাংলা ভাষার বিভিন্ন বই বিদেশি ভাষায় অনুবাদ করার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেন মনোরোগ চিকিৎসক ও বন্ধুসভার উপদেষ্টা মোহিত কামাল। তিনি বলেন, ‘অনুবাদের মাধ্যমে আমরা সারা বিশ্বে আমাদের সাহিত্য ছড়িয়ে দিতে পারি। এতে সারা পৃথিবী বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহী হবে।’

জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি জাফর সাদিক বলেন, ‘বন্ধুসভার দাপ্তরিক ভাষা বাংলা। সব কাজকর্মে বাংলা ব্যবহার করি। বন্ধুসভার বন্ধুদের মধ্যে শুদ্ধ বাংলা চর্চার প্রচেষ্টা করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত।’ আরও বক্তব্য দেন জাতীয় পর্ষদের সহসভাপতি মাহবুব পারভেজ, সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন মল্লিক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গাজী আনিস ও ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার সহসভাপতি মাহমুদা বুশরা।

আলোচনা শেষে প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। বন্ধুদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন অতিথিরা। সাংস্কৃতিক পর্বে ছিল ভাষাশহীদদের প্রতি নিবেদন করে গান, কবিতা আবৃত্তি ও নৃত্য পরিবেশনা। সঞ্চালনা করেন ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার সহসভাপতি সাফিন উজ জামান ও তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক ওয়াসিমা তাসনিম। দলীয় নৃত্য প্রদর্শন করেন ক্যামব্রিয়ান কলেজ বন্ধুসভার রোজা, মালিহা, লুশান্তা এবং একক নৃত্য প্রদর্শন করেন বন্ধু আফিফা। গান পরিবেশনা করেন কেরানীগঞ্জ বন্ধুসভার সহসভাপতি তানজিমা নুসরাত, জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক পৌলমি অদিতি ও কার্যনির্বাহী সদস্য হৃদয় সৈকত। কবিতা আবৃত্তি করেন ক্যামব্রিয়ান কলেজ বন্ধুসভার নুসাইবা জাহান, বন্ধু জয় হাসান এবং জাতীয় পর্ষদের সহসভাপতি মাহবুব পারভেজ। সবশেষে বন্ধু হৃদয় সৈকতের গানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের ইতি টানা হয়।

তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা