ঘরের বারান্দায় নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এক কিশোরী (১৪)। সে স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। ছয় বছর বয়স থেকে এখানে থাকছে। ভিক্ষাবৃত্তি করতেন মা–বাবা। অভাবের তাড়নায় ৯ বছর আগে স্থানীয় এক নারীর কাছে পালতে দেন। অসুস্থ ওই নারী কিশোরীকে সেফ হোমে রাখেন। এর পর থেকে কোনো দিন কেউ খোঁজ নেয়নি তার।
রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ায় অবস্থিত বেসরকারি সংস্থা পায়াকট বাংলাদেশ পরিচালিত সেফ হোমে এমন ১৫ শিশু–কিশোরী রয়েছে। অন্যান্য শিশু–কিশোরীর চোখেমুখেও দুশ্চিন্তার ছাপ। বেশির ভাগ শিশুরা তাদের বাবা কে, বলতে পারে না। মা থাকলেও যৌনপল্লি বা ঘাট এলাকায় ভিক্ষাবৃত্তি করেন। তাঁরা কেউ কোনো দিন খোঁজ নেন না। এ জন্য ঈদের আনন্দ নেই। কোনোভাবে দিন কেটে যাচ্ছে তাদের। গোয়ালন্দ বন্ধুসভার নতুন জামা পেয়ে আনন্দে চোখে জল গড়িয়ে পড়ে। অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ওই কিশোরী বলে, ‘আপনারা এই জামা না দিলে হয়তো ঈদে নতুন কোনো জামাই হতো না।’
ওই কিশোরীর মতো আরেক কিশোরী (১৪) স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। বাবা কে, তার জানা নেই। ভবঘুরে মা ঘাট এলাকায় থাকেন। ৯ বছর আগে উদ্ধার করে সেফ হোমে আনা হয়। এর পর থেকে এখানেই সবকিছু। এই কিশোরীও জানে না তার ভবিষ্যৎ কী। ঈদ এলে অপেক্ষায় থাকে কেউ কিছু দেবে কি না? তার হাতে তুলে দেওয়া হয় নতুন জামা। ফ্রকটি হাতে পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলে, ‘এ বছর এখন পর্যন্ত নতুন জামা পায়নি। ঈদের দিন এই জামা পরে ঘুরব, আনন্দ করব।’
২৫ মার্চ সন্ধ্যায় শিশুদের সঙ্গে ‘সহমর্মিতার ঈদ’ কর্মসূচি পালন করতে উপস্থিত হন গোয়ালন্দ বন্ধুসভার সদস্যরা। প্রত্যেকের হাতে তুলে দেওয়া হয় নতুন পোশাক। রঙিন পোশাক পেয়ে আনন্দ যেন মাটিতে পড়ে না। পোশাক বিতরণ শেষে তাদের জন্য ইফতারি ও ভারী খাবারের ব্যবস্থা করেন বন্ধুরা।
এ সময় প্রথম আলো রাজবাড়ী প্রতিনিধি এম রাশেদুল হক, গোয়ালন্দ সাংবাদিক ফোরামের আহ্বায়ক হেলাল মাহমুদ, সদস্যসচিব মোজাম্মেল হক লাল্টু, গোয়ালন্দ বন্ধুসভার সভাপতি জীবন চক্রবর্তী, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবুল হোসেন, পায়াকট বাংলাদেশ দৌলতদিয়া কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক মজিবর রহমান জুয়েল, গোয়ালন্দ বন্ধুসভার সহসভাপতি মইনুল হক মৃধা, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সফিক মন্ডল, সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন, সাংবাদিক ফোরামের সদস্য শফিক শামীম, শেখ মোমিন, শাকিল মোল্লা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মকর্তা রাসেল মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন।
মজিবর রহমান জুয়েল জানান, ইউএনডিপির অর্থায়নে সমাজসেবার মাধ্যমে ২০০০ সাল থেকে সুবিধাবঞ্চিত ১২০ নারী ও শিশু নিয়ে সংস্থাটি সেফ হোম চালু করে। ২০০৭ সালের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে শিশুদের অভিভাবকদের কাছে দেওয়া হয়। ১২০ জনের মধ্যে ২১ শিশুর অভিভাবক না পাওয়ায় ২০০৭ সালের ১ জুলাই থেকে নিজস্ব অর্থায়নে অদ্যাবধি প্রকল্প চালু রেখেছে। শিশুদের বড় করে তোলা, মেয়েদের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে সমাজে মূলধারায় সম্পৃক্ত করছে। উচ্চশিক্ষার জন্য অধ্যয়নের ব্যবস্থা করছে। বিবাহিত মেয়েরা বাবার বাড়ি বলতে পায়াকট বোঝায়। ঈদসহ বড় উৎসবে ছুটে আসেন তাঁরা; সঙ্গে জামাই, শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ ও দেবর পর্যন্ত নিয়ে আসেন। তাঁদের জন্য উন্নত খাবার ও নতুন পোশাকের ব্যবস্থা করা হয়। স্বামীর বাড়ি যাওয়ার গাড়ি ভাড়া পর্যন্ত প্রদান করা হয়।
মজিবর রহমান জুয়েল বলেন, ‘বর্তমানে সেফ হোমে ১৫ ছেলে ও মেয়েশিশু রয়েছে। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে সুযোগ–সুবিধা দেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার, দেশ ও বিদেশের বড় সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও বিত্তবান মানবিক মানুষদের কাছে আবেদন, সবার সহযোগিতা পেলে এসব শিশুকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে পারব।’
গোয়ালন্দ সাংবাদিক ফোরামের আহ্বায়ক হেলাল মাহমুদ বলেন, ‘যা কিছু ভালো, তার সঙ্গে প্রথম আলো’ স্লোগানে বন্ধুসভার সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে নানা ভালো কাজ করে যাচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় শিশুদের মধ্যে রঙিন পোশাক বিতরণ, তাদের জন্য ইফতারি ও উন্নতমানের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। এতেই বলে দেয় বন্ধুসভা সব সময় ভালো কিছুই করে থাকে।’
গোয়ালন্দ বন্ধুসভার সভাপতি জীবন চক্রবর্তী বলেন, ‘সহমর্মিতার ঈদ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঈদের আগে এই শিশুদের জন্য এমন ভালো কিছু করতে পেরে আমরা খুবই আনন্দিত। আমাদের এ ধরনের ভালো কাজের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে ইনশা আল্লাহ।’