যেভাবে নিরক্ষরমুক্ত হয় কচুবাড়ি-কৃষ্টপুর গ্রাম
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশকে এগিয়ে নিতে শিক্ষার বিকল্প নেই। ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে— সরকারের এমন উদ্যোগের পর ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার কচুবাড়ি-কৃষ্টপুর দেশের প্রথম নিরক্ষরমুক্ত গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ৮ সেপ্টেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। এ উপলক্ষে ঠাকুরগাঁও বন্ধুসভার সদস্যরা গ্রামটি পরিদর্শন করে গ্রামটি নিরক্ষরমুক্ত হওয়ার গল্প শোনেন।
দেশের প্রথম নিরক্ষরমুক্ত গ্রাম গঠনের ওই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্থানীয় তরুণ মোকছেদ আলী। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আবদুল খালেক, আকলিমা বেগম, রিয়াজুল ইসলাম, লুৎফর রহমান, তৈয়বা খাতুন, হাফিজুর রহমান, আবদুল জব্বার, হাসিবুল হকসহ কয়েকজন।
যেভাবে নিরক্ষরমুক্ত হয় কচুবাড়ি-কৃষ্টপুর গ্রাম
১৯৭২ সালে নিরক্ষরমুক্তির আন্দোলনের শুরুতেই আন্দোলনে যুক্ত তরুণ-যুবকেরা গ্রামে মিছিল করে জানান দেন ‘টিপসই ছি ছি, শিখো নাম লিখিতে’। পরে ফসলের খেতে পুরুষদের ও চুলার পাশে বসে নারীদের নাম লেখা শেখানোর পাশাপাশি শেখানো হয় অ, আ...ক, খ।
গ্রামের তরুণ-যুবকেরা শহরের বিভিন্ন কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের গিয়ে বলেন, তাঁদের গ্রামের কেউ টিপসই দিতে চাইলে, তাঁর কাছ থেকে যেন ‘নাক সই (নাকখত)’ নেওয়া হয়। পরে নাক সইয়ের অপমান থেকে বাঁচার জন্য বয়স্ক ব্যক্তিরা গ্রামের শিক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে বলেন, ‘বাবারে, নাম লেখা শিখায়ে দে।’ তরুণ-যুবাদের তিন মাসের পরিশ্রমে গ্রামটি অবশেষে নিরক্ষরমুক্ত হয়ে ওঠে।
মোকছেদ আলীর সহযোগী তৈয়বা বেগম জনান, কচুবাড়ি-কৃষ্টপুর গ্রামের কৃতিত্বকে সম্মান জানাতে ১৯৭৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁও শহরে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ খবরে অন্য গ্রামের যুবকেরাও নিরক্ষরতা থেকে মুক্তির প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন। দুই মাসের আন্দোলনে আরও কয়েকটি গ্রাম থেকে টিপ সই দূর হয়ে যায়।
নিরক্ষরতা মুক্তির আন্দোলন চলাকালে কচুবাড়ি-কৃষ্টপুর গ্রামে বউ হয়ে আসেন আকলিমা বেগম। এসেই জড়িয়ে পড়েন আন্দোলনে। আকলিমা বলেন, ‘আমাদের এই কৃতিত্বকে সম্মান জানাতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ঠাকুরগাঁওয়ে আসবেন শুনে গ্রামের মানুষ ব্যাপক প্রস্তুতি নেন। কিন্তু অতিথিরা ঠাকুরগাঁওয়ে এলেও নিরাপত্তার অজুহাতে আমাদের গ্রামে যাননি। তবে রাষ্ট্রপতি মোকছেদ আলীকে একটি ফাউন্টেইন পেন উপহার দিয়ে যান।’
মোকছেদ আলীর সহযোদ্ধারা আরও জানান, নিরক্ষরতা মুক্তির আন্দোলন যাঁরা করেছেন, তাঁদের তেমন স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। মোকছেদ দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মারা যান। মোকছেদের দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছেলে আল আমিন সংসারের চাকা সচল রাখতে অন্য জায়গায় চলে গেছেন।
মোকছেদ আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্ত্রী জাহেদা খাতুন ঘরের বারান্দায় একটি ছাগল নিয়ে বসে আছেন। বন্ধুসভার সদস্যদের পরিচয় পেয়ে ছুটে এলেন দুই তরুণী। তাঁদের একজন রাবেয়া মল্লিকা। সে মোকছেদ আলীর ছোট ভাইয়ের মেয়ে। রাবেয়া বলেন, ‘সেপ্টেম্বর মাস এলেই কত মানুষ আমাদের এখানে এসে খোঁজখবর নেয়। কিন্তু এর পর আর তাদের দেখা পাওয়া যায় না।’
জাহেদা খাতুন জানান, ২০০৭ সালে তাঁর স্বামী মোকছেদ আলী মারা যান। আর্থিক অনটনে ছেলের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এখন ছেলে একটি খামারে মজুরি করে।
মোকছেদ আলীর ছেলে আল আমিন মুঠোফোনে বলেন, ‘কচুবাড়ি-কৃষ্টপুর গ্রামকে নিরক্ষরমুক্ত করার পর ১৯৭৩ সালে বাবা রাষ্ট্রপতি পদক পেয়েছিলেন। সেই স্মৃতি গর্বের হলেও, এখন তা যন্ত্রণার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভাবের কারণে বাবার দেখানো সেই পথে হাঁটতেও পারিনি।’
বন্ধুসভার স্বাস্থ্য ও ক্রীড়া সম্পাদক মারুফ হাসান বলেন, ‘দেশের প্রথম নিরক্ষরমুক্ত গ্রাম গড়ে তোলার কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে অনুপ্রাণিত হয়েছি। সুযোগ পেলে আমরাও এমন কাজ হাতে নেব।’
পরিদর্শন শেষে বন্ধু মারজান বলেন, ‘তিন মাসে একটি গ্রাম নিরক্ষরমুক্ত করা সম্ভব, কচুবাড়ি-কৃষ্টপুরে না গেলে জানতেই পারতাম না। এই কর্মযজ্ঞের পেছনে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের স্যালুট জানাই।’
সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শিহাব বলেন, ‘নিরক্ষরমুক্ত করে কচুবাড়ি-কৃষ্টপুরের তরুণ-যুবকেরা গ্রামে যে আলো জ্বালিয়েছিল, তা গর্বের। আমরা এ গ্রামটি পরিদর্শন করে সমৃদ্ধ হয়েছি। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় একটা কঠিন কাজও সহজ হয়ে যায়।’
এই কার্যক্রমে আরও উপস্থিত ছিলেন ঠাকুরগাঁও বন্ধুসভার বন্ধু তপু রায়, মিথিলা আক্তার, রুদ্র মহন্ত, সাজ্জাদ হোসেন, মো. আলিফ।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ঠাকুরগাঁও বন্ধুসভা