১ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার। গ্রীষ্মের এক কোমল ভোর। সূর্য তখনো পূর্বাকাশে পাখা মেলেনি, অথচ পটিয়া রেলস্টেশনে জড়ো হয়েছেন ৩০ জন তরুণ-তরুণীর একটি প্রাণবন্ত দল—প্রথম আলো পটিয়া বন্ধুসভার মুখগুলো। হাতে ভ্রমণের ব্যাগ, চোখে স্বপ্ন, আর মনে অফুরন্ত আনন্দ নিয়ে তাঁরা অপেক্ষা করছেন এক বিশেষ যাত্রার জন্য। গন্তব্য—সবুজ পাহাড় আর নীল জলরাশির কক্সবাজার।
সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে যখন সৈকত এক্সপ্রেস ট্রেনটির বাঁশি বেজে ওঠে, বন্ধুরা চেপে বসেন নির্দিষ্ট বগিতে। ট্রেনের জানালা দিয়ে ছুটে যেতে থাকে প্রকৃতির শোভা, আর বগির ভেতর বয়ে যায় গানের ঢেউ। বন্ধু মোকাররম রিজুর আগেভাগে প্রস্তুত করা বাদ্যযন্ত্রে ভর করে শুরু হয় এক মোহময় সংগীতযাত্রা। উকুলেলে, তবলা, ঝনঝনে তালের সঙ্গে গান গেয়ে ওঠেন বন্ধু হিরা, মুনশীল, ফারুকসহ অন্যরা। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান, মুর্শিদি—সব মিলিয়ে পুরো বগি যেন হয়ে ওঠে ভ্রাম্যমাণ মঞ্চ।
সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে ট্রেন থামে কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনে। নেমেই এক নিশ্বাসে প্রশান্তি খুঁজে নেয় হৃদয়। সাগরের কাছাকাছি এমন ছিমছাম স্টেশন যেন স্বপ্নের দৃশ্য। মুহূর্তগুলোকে স্মৃতিতে বাঁধতে বন্ধুরা তোলে দলগত ছবি। এরপর সবাই রওনা দেন ডলফিন মোড়, কলাতলী হয়ে ওয়ার্ল্ড বিচ রিসোর্টে। ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাওয়া হয় পউষি রেস্টুরেন্টে।
বিকেলের সূর্য যখন সাগরের জলে লাল রং ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছে, বন্ধুরা পা রাখেন সৈকতে। শিশুর মতো ছুটে বেড়ান, বালু দিয়ে গড়ে তোলেন বন্ধুত্বের দুর্গ। আর সন্ধ্যার পর রিসোর্টের অডিটরিয়ামে শুরু হয় সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা।
পর্বের শুরুতেই প্রাণবন্ত সঞ্চালনায় মঞ্চে আসেন বন্ধু হিরা, মুনশীল, সুপ্রিয়া, সূফি, রাজু ও রিজু। একে একে গান গেয়ে শোনান প্রিয় মুখগুলো। সুপ্রিয়ার নাচে মোহিত হয় সবাই, আর রবীন্দ্রসংগীতে হিরা, সুপ্রিয়া ও আইরিন সুলতানা ছড়িয়ে দেন এক অপার্থিব অনুভূতি।
এরপর উপস্থিত হন প্রথম আলো পটিয়ার প্রতিনিধি আবদুর রাজ্জাক। মে দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে তিনি কৃতজ্ঞতা জানান যাঁদের অক্লান্ত শ্রমে এই ভ্রমণ বাস্তবায়িত হয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখ করেন আহ্বায়ক কাজী সোহেলকে, যিনি ছিলেন সার্বিক পরিকল্পনার মূলে। কাজী সোহেল স্যারও অনবদ্য অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য প্রদান করেন এবং ওনাকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়।
বন্ধু শোয়েব মোহাম্মদ তাঁর অনুভূতির কথা ভাগ করে নেন। সন্ধ্যার এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত আসে তখন—বন্ধুসভার পাঁচজন নিবেদিতপ্রাণ সদস্যকে ‘সেরা সদস্য: বন্ধুত্ব, সেবা ও অনন্য অবদান’ হিসেবে সম্মাননা দেওয়া হয়। এই গৌরব অর্জন করেন বন্ধু শচীন দে, মোকাররম রিজু, সূফি মোহাম্মদ রেজা, তানাস চৌধুরী ও মো. রাশেদুল্লাহ। তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ক্রেস্ট—বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে।
পরদিন, ২ মে সকালে বন্ধুরা চলে যান সুগন্ধা বিচের ঝাউবনে, যেখানে অপেক্ষায় এক মজার খেলা—পিলো পাসিং। খেলার নিয়মে মজে যায় সবাই। নারীরা দুর্ভাগ্যক্রমে আউট হলেও ছেলেরা ছিনিয়ে নেয় বিজয়। প্রথম স্থান অধিকার করেন বন্ধু মো. মানিক, দ্বিতীয় মো. রাশেদুল্লাহ ও তৃতীয় হন সোহান আলম। পুরস্কার নেওয়ার সময় সবার চোখে ছিল আনন্দের ঝিলিক, আর মনভরা প্রশান্তি। অংশগ্রহণকারী সবার জন্য ছিল শুভেচ্ছা পুরস্কারও।
রাত আটটায় বন্ধুরা আবার পৌঁছে যান কক্সবাজার রেলস্টেশনে। কিছুটা দেরিতে সৈকত এক্সপ্রেস ছাড়লেও মনখারাপের সময় ছিল না, কারণ ফেরার পথেও চলে এক ঘণ্টা দীর্ঘ সংগীতযাত্রা। বন্ধু আরিফ হোসেন, জুয়েল, আশিক ফারুক ও রিজু মিলে পরিবেশন করেন এমন সব গান, যা দীর্ঘদিন মনে থেকে যাবে। যাত্রার সঙ্গী ছিলেন কিছু প্রিয় মুখ— সহকারী সার্জন ডা. উম্মুল খাইর মারজান ও তাঁর জীবনসঙ্গী শোয়েব মোহাম্মদ, ব্যাংকার সেলিম রুবেল, ফয়েজ রাসেলসহ অনেকে।
দুই দিনের এই সফর যেন ছিল এক গাথা—গান, গল্প, বন্ধুত্ব আর সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া কিছু স্বর্ণালি মুহূর্তের মেলবন্ধন। সব মিলিয়ে পটিয়া বন্ধুসভার কক্সবাজার ভ্রমণ ছিল হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এক স্মৃতিময় অভিযাত্রা, যা বন্ধুদের মনে রয়ে যাবে আজীবন।
সাধারণ সম্পাদক, পটিয়া বন্ধুসভা