‘মেয়েরা এবার নতুন জামা পরব, পেটভরে ঈদের খাবার খাইব’

একটি পরিবারের জন্য ঈদ খাদ্যসামগ্রী উপহার দিচ্ছেন রাজশাহী বন্ধুসভার সভাপতি মিজানুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক তাহমিনা আক্তারছবি: বন্ধুসভা

মেয়েটির ছোট্ট হাতে যখন নতুন জামাটি তুলে দেওয়া হলো, সে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর মুখজুড়ে ফুটে উঠল একচিলতে হাসি। খুশিতে লাফিয়ে উঠল সে। ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মা, এবার আমিও ঈদে নতুন জামা পরব!’ তারপর দৌড়ে গেল ছোট দুই বোনের কাছে, তাদেরও নতুন জামা পরিয়ে দিল।

বলছি রাজশাহী নগরের চৌদ্দপাই এলাকার মেয়ে সাবিহা খাতুনের কথা। বয়স মাত্র সাত বছর। পরপর তিনটি মেয়েসন্তান হওয়ায় বাবা তার মাকে রেখে চলে গেছেন। সে এখন ছোট দুই বোন, মা, আর নানির সঙ্গে দুই কক্ষের জরাজীর্ণ একটি টিনশেডের বাড়িতে ভাড়া থাকে। ঘর দুটি এতটাই জরাজীর্ণ যে বৃষ্টি হলে বাইরের পানি ঢুকে। বাড়ির ভাড়াবাবদ প্রতি মাসে তাদের সাড়ে তিন হাজার টাকা গুনতে হয়। পরিবারে সহায়তা করতে সাবিহাকে এই বয়সেই রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বাদাম বিক্রি করতে হয়। মা পূর্ণিমা দিনের বেলায় পুরোনো কাপড় সংগ্রহ করে বিক্রি করেন। আর নানি মনোয়ারা বেওয়া অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। রাতে তাঁরা দুজন সাবিহাকে নিয়ে বাদাম বিক্রি করতে বের হন।

‘সহমর্মিতার ঈদ’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দিতে এমন দুটি দুর্দশাগ্রস্থ পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে রাজশাহী বন্ধুসভা। ২৬ মার্চ দুপুরে তাদের হাতে ঈদসামগ্রী তুলে দেন বন্ধুসভার বন্ধুরা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলো রাজশাহীর নিজস্ব প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, প্রথম আলোর রাজশাহী প্রতিনিধি শফিকুল ইসলাম, রাজশাহী বন্ধুসভার সভাপতি মিজানুর রহমান, সহসভাপতি উৎসব সরকার, সাধারণ সম্পাদক তাহমিনা আক্তার, সাংস্কৃতিক সম্পাদক নাহিদ হাসান, দুর্যোগ ও ত্রাণ সম্পাদক নিশাত তাসনিম এবং রাজশাহী শাহ্ মখদুম কলেজের শিক্ষক সাখাওয়াত হোসেন।

ঈদসামগ্রী এবং নতুন শাড়ি পেয়ে সাবিহার মা পূর্ণিমা আনন্দে আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন, ‘এত দিন শুধু মেয়েদের কথায় ভাবতাম। ওরা নতুন জামা না পাইলে কষ্ট পায়, ঈদের দিনে মুখ গোমড়া কইরা বইসা থাকে। কিন্তু আজ আমিও একটা নতুন শাড়ি পাইছি! আজ কত বছর পর নতুন শাড়ি পরমু, মনে নাই! নিজের জন্য কখনো কিছু চাইতে পারি নাই। আজ না চাইয়াও পাইলাম। মেয়েরা এবার নতুন জামা পরব, পেটভরে ঈদের খাবার খাইব। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছু হইতে পারে না।’

উপহার পেয়ে সাবিহার নানি মনোয়ারা বেওয়া বলেন, ‘জীবনে কত বাড়িতে কাম করনু, কত ঈদ আইল-গেল, কহনো নিজের জন্য কিছু পাই নাই। বয়স হইছে, চাইতে ভুলে গেছি। কিন্তু এই শাড়িটা হাতে নিয়া মনে হইতাছে, আমিও তো মানুষ! আমিও তো নতুন শাড়ি পরতে পারি!’

এক নারীর হাতে তাঁর পরিবারের জন্য ঈদ খাদ্যসামগ্রী তুলে দিচ্ছেন প্রথম আলো রাজশাহী প্রতিনিধি শফিকুল ইসলাম
ছবি: বন্ধুসভা

সাবিহার তিনটি খরগোশছানা আছে। সেগুলোই তার সারা দিনের খেলার সঙ্গী। ঈদ উপলক্ষে সাবিহাদের পাশাপাশি খরগোশগুলোর জন্যও খাবারের ব্যবস্থা করে দেন বন্ধুসভার বন্ধুরা। সাবিহার খালাতো ভাই মোরসালিন। বয়স মাত্র ৮। সে–ও তার মা মেরিনা বেগম আর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকে। উপার্জনের ব্যবস্থা না থাকায় তাদেরকেও অনেক কষ্ট করে পরিবার চালাতে হয়। ঈদ উপলক্ষে তাদের হাতেও ঈদসামগ্রী এবং নতুন জামা কাপড় তুলে দেওয়া হয়।

রাজশাহী বন্ধুসভার সভাপতি মিজানুর রহমান এ ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, এ ধরনের উদ্যোগ শুধু মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য নয়; বরং তাঁদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং সামাজিক দায়িত্ববোধও সৃষ্টি করে। বন্ধুসভার লক্ষ্য শুধু সেবা প্রদান করা নয়; বরং সমাজের প্রতিটি অংশকে এই কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা গড়ে তোলা। আমাদের প্রত্যাশা, এ ধরনের কার্যক্রম চলতে থাকলে গরিব-দুঃখী মানুষদের মধ্যে যে আনন্দের আলো ফুটবে, তা সমাজে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। এই উদ্যোগগুলো দীর্ঘমেয়াদি চলতে থাকলে আমরা আরও বেশি মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারব।’

সহসভাপতি, রাজশাহী বন্ধুসভা