মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তৎকালীন যুগের ঔপন্যাসিকদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচয়িতা। তাঁর রচনার ভাবভঙ্গি, ভাষা, চরিত্র সৃজনের যে ক্ষমতা—সবকিছু পাঠকদের অবাক করে। তাঁর লেখা উপন্যাস পড়তে পড়তে পাঠক এক অন্য বিশ্লেষণের জগতে পৌঁছে যান। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সে-রকমই লেখা উপন্যাস ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র শশী, পেশায় ডাক্তার। গাওদিয়া গ্রামে বড় হলেও জীবনের দীর্ঘ সময় কলকাতায় অতিবাহিত করেছে। স্বভাবতই তার চিন্তাধারা গাওদিয়া গ্রামের আর পাঁচটা মানুষের চিন্তাধারা থেকে ভিন্ন। তার বাবা গোপাল একজন সুদখোর মহাজন ব্যবসায়ী, জীবনে টাকাপয়সা বা ব্যবসায়িক লাভের জন্য ভুল কাজ করতেও পিছপা হন না তিনি। এ জন্য গ্রামের সবাই তাকে খুব একটা পছন্দ করে না।
পুরো উপন্যাসে দেখা যায়, শশী ও তার বাবার মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব কাজ করে। আরেকটি চরিত্র হারু, যার মৃত্যুর মাধ্যমে উপন্যাসের সূচনা, আর তার চারপাশের মানুষদের প্রতিক্রিয়া দিয়েই আমাদের সামনে ধীরে ধীরে খুলে যায় একটি সমাজের অব্যক্ত ইতিহাস। গ্রামের মানুষের আতঙ্ক, কুসংস্কার, সম্পর্কের জটিলতা এবং সামাজিক অবহেলার গল্প ক্রমশ গাঢ় হয়।
হারুর ছেলে পরাণ, পুত্রবধূ কুসুম, আর অবিবাহিত মেয়ে মতি—এই তিন চরিত্রের সঙ্গে পরবর্তী সময়ে শশীর একটা সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা যায়। কুসুম চরিত্রটি বিশেষভাবে মন কাড়ে। গ্রাম্য, নিরক্ষর এক নারী হওয়া সত্ত্বেও তার আচরণে নাটকীয়তা, উপস্থিত বুদ্ধি এবং বাস্তবতার স্বীকৃতিতে কাহিনির গতিতে নানা মাত্রিকতা এনেছে। শশীর সঙ্গে তার সম্পর্ক প্রেমে সীমাবদ্ধ না থেকে সামাজিক অবস্থান ও পরিস্থিতির প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। যাদব পণ্ডিত, সেন দিদি, যামিনী কবিরাজ, পরাণ, সরলা, এমনকি যাত্রার নাটকীয় পরিবেশ—সবই মিলে এই গ্রামীণ সমাজ একটি জটিল অথচ জীবন্ত চরিত্র হয়ে ওঠে।
শশীর গ্রামত্যাগের চেষ্টা, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, কুসুমের অন্তর্ধান, বাবার কৌশলে দায়িত্ব দিয়ে চলে যাওয়া—সব মিলিয়ে শশী বারবার চায় গ্রাম ছেড়ে যেতে; কিন্তু বারবার আটকে যায় সামাজিক দায়িত্ব, আত্মিক টান আর বাস্তবতার জালে। শশী যেন নিজেই এক পুতুল, যাকে টেনে ধরে রেখেছে সমাজ, পরিবার ও সম্পর্কের সুতা। এই উপন্যাস বুঝিয়ে দেয়—মানুষ কখনো নিজের নিয়ন্ত্রক নয়, সমাজ, সম্পর্ক ও বাস্তবতাই তাকে নাচিয়ে বেড়ায়। এখানেই আসে ‘পুতুলনাচ’-এর প্রতীক।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ উপন্যাসটি নিয়ে পাঠচক্রের আসর করে সিলেট বন্ধুসভা। ১ আগস্ট প্রথম আলো সিলেট অফিসের বন্ধুসভা কক্ষে এটি অনুষ্ঠিত হয়।
পাঠচক্রে বইটির বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করে বন্ধু অনুপমা দাস বলেন, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ একাধারে সমাজচিত্র, শ্রেণিচেতনা ও মানুষের অদম্য বেঁচে থাকার কাহিনি।
বন্ধু অম্লান রায় বলেন, একটা সমাজ আর সময়কে যেভাবে লেখক জীবন্ত করে তুলেছেন, তা অসাধারণ।
এ ছাড়া বইটি পাঠ করেন বন্ধু প্রত্যাশা তালুকদার ও সুবর্ণা দেব। পাঠের আসরে আরও উপস্থিত ছিলেন বন্ধু দেব রায় সৌমেন, ফয়সাল আহমেদ, সমরজিৎ হালদার, শতাব্দী দত্ত, প্রীতম তালুকদার, মাহবুব হোসাইনসহ অন্য বন্ধুরা।
পাঠাগার ও পাঠচক্র সম্পাদক, সিলেট বন্ধুসভা