২৫ বছরে বন্ধুত্বের শক্তি

প্রথম আলোর পাঠক সংগঠন বন্ধুসভা। দেশ ও দেশের বাইরের ১৪০টি বন্ধুসভার লক্ষাধিক বন্ধুর এই সংগঠন আত্মোন্নয়ন ও মানুষের সেবায় নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। যেকোনো দুর্যোগে মানবতার সেবায় বন্ধুরা ঝাঁপিয়ে পড়েন, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১১ নভেম্বর ২৫ পেরিয়ে ২৬ বছরে পদার্পণ করবে বন্ধুসভা। এদিন ভালো কাজ, সহমর্মিতার ঈদ, বৃক্ষরোপণ ও বর্ষসেরা বন্ধুসভাগুলোকে সম্মাননা দেওয়া হবে।

প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে একটি করে ভালো কাজের অংশ হিসেবে বন্ধন আদর্শ বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করে দিয়েছে কেরানীগঞ্জ বন্ধুসভা
ছবি: বন্ধুসভা

‘বল বীর—
চির উন্নত মম শির।

বিদ্রোহী কবির তেজ বন্ধুসভায় সেই ১৯৯৮ থেকেই বিরাজমান। দিনটি ছিল বুধবার। ১৯৯৮ সালের ১১ নভেম্বর প্রথম বন্ধুসভার পাতা প্রকাশিত হয়।

বন্ধুসভা এখন পরিণত ২৫। ১১ নভেম্বর ২৫ বছর পূর্ণ করে ২৬ বছরে পদার্পণ করবে বন্ধুসভা। গত বছর ১১ নভেম্বর লিখেছিলাম, বন্ধুসভা এখন ২৪ বছরের টগবগে যুবক। এবার বন্ধুসভা পরিপক্বতা লাভ করেছে। ২৫ বছর খুব তাৎপর্যপূর্ণ বয়স। ৪ নভেম্বর আমরা প্রথম আলোর রজতজয়ন্তী উদ্‌যাপন করেছি। সত্যে তথ্যে ২৫ বছর সফলতার সঙ্গে অনেক চড়াই-উতরাই পার করে প্রথম আলো আজ দেশসেরা জাতীয় দৈনিক। আর বন্ধুসভা হচ্ছে সেই প্রথম আলোর প্রাণ!

বন্ধুসভাকে বলা যায় মানবিক মানুষ তৈরির কারখানা। ১৯৯৮ থেকে ২০২৩—এই ২৫ বছরের পথচলায় অগণিত গল্প রয়েছে আমাদের মানবিক বন্ধুদের। বন্ধুসভা একঝাঁক সাহসী, উদ্যমী, প্রত্যয়ী, বলিষ্ঠ, অকুতোভয়, নির্ভীক, দুর্বিনীত, স্বপ্নবান তরুণের স্বপ্ন দেখার সূচনাস্থল। বন্ধুসভা মানে সুস্থ চিন্তাচেতনা, মানসিকতা, সৃজনশীল চিন্তা ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ গড়ার ক্ষেত্র। বন্ধুরা নিজেদের সবটুকু চেষ্টা দিয়ে মানবতার সেবায় সোচ্চার সর্বদা।

সড়কের গতিরোধক (স্পিড ব্রেকার) চিহ্নিতকরণে রং করে দিয়েছেন গোয়ালন্দ বন্ধুসভার বন্ধুরা
ছবি: বন্ধুসভা

এবার প্রথম আলোর রজতজয়ন্তী উপলক্ষে ‘একটি করে ভালো কাজ’ শিরোনামে সারা দেশের অসংখ্য বন্ধুসভা ব্যতিক্রমী সব উদ্যোগ নিয়েছে। চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মইশকরম গ্রামে ৪০০ বর্গফুটের একটি টিনশেড ঘরে বন্ধুরা প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘বন্ধু পাঠশালা’ নামে একটি স্কুল। গত ২৬ অক্টোবর ছিন্নমূল ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য এটি চালু করেছে রাউজান বন্ধুসভা। প্রতি সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার ২ দিন ২২ জন শিক্ষক বন্ধু পালাক্রমে এই শিশুদের পড়ান।

ঝিনাইদহ শহরের পাগলাকানাই থেকে সাত কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত গ্রাম ডেফলবাড়িয়ায় একটি টিনের জীর্ণশীর্ণ দোচলা ঘরে এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে নূরনাহার বেগমের বসবাস। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে শুরু হয় তাঁর চরম দুঃখের জীবন। অসহায় এই বিধবার কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে ঝিনাইদহ বন্ধুসভা। নূরনাহার বেগমকে সেলাই মেশিন, কিছু কাপড় ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কিনে দিয়েছেন বন্ধুরা। পাশাপাশি ‘প্রথমা টেইলার্স’ নামে বাড়ির পাশে একটি দোকানও করে দেওয়া হয়েছে।

গাইবান্ধা বন্ধুসভার বন্ধুরা বৃদ্ধাশ্রমের প্রবীণদের সঙ্গে সুন্দর দিন অতিবাহিত করেন
ছবি: বন্ধুসভা

একটি করে ভালো কাজের অংশ হিসেবে এবার সিলেট বন্ধুসভা অভিনব এক কাজ করেছে। দরিদ্র দিনমজুরকে ‘বন্ধু স্টল’ উপহার দিয়েছে তারা। আনোয়ার মিয়া (৫৯) আগে রাস্তায় ভ্যানে করে চা বিক্রি করতেন। ভ্যানগাড়িটা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তাঁর নিয়মিত কাজ ব্যাহত হয়। ৩০ অক্টোবর সিলেট বন্ধুসভার বন্ধুরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আনোয়ার মিয়ার হাতে একটি নতুন ভ্যানগাড়ি হস্তান্তর করেন, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘বন্ধু স্টল’। আনুষঙ্গিক মালামালও কিনে দিয়েছেন।

সাতক্ষীরার টুম্পা ও নূরজাহান বিবিদের গল্প আরও কঠিন। প্রত্যন্ত অঞ্চল বলে প্রশিক্ষণের সুযোগ নেই। স্বামী-সংসার নিয়ে খুব কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয় সবাইকে। গত ৩০ অক্টোবর দরিদ্র ও বিধবা ২৫ জন নারীকে হস্তশিল্প ও সেলাইয়ের কাজের প্রশিক্ষণ দিয়েছে সাতক্ষীরা বন্ধুসভা।

সাতক্ষীরা বন্ধুসভার উদ্যোগে নারীদের হস্তশিল্প ও সেলাই প্রশিক্ষণ
ছবি: বন্ধুসভা

দিনাজপুরের জানকী রায় ও সুবর্ণাদের গল্পও সুখকর নয়। দিনাজপুর বন্ধুসভার বন্ধুরা জানকী-সুবর্ণাদের পরিবারের মতো ২৫টি দুস্থ পরিবারের মধ্যে এক জোড়া হাঁস ও এক প্যাকেট করে লাউয়ের বীজ উপহার দিয়েছেন। গৃহবধূ সুবর্ণা বলেন, ‘আমরা ভালোমতো হাঁসের দেখাশোনা করব। ঘরে ছোট বাচ্চা আছে, ভালোমন্দ খাওয়াতে পারি না। হাঁস বড় হলে ডিম দিলে বাচ্চাকে খাওয়াতে পারব।’

চট্টগ্রামের একটি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী নওরিন। ছয় ভাইবোন ও বাবা-মা নিয়ে সংসার। বাবা ৫৮ বছর বয়সী সেলিম হোসেন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর থেকে সংসার কোনোমতে চলছে। তাই নওরিনের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া পর্যন্ত নওরীনের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্ধুসভার বন্ধুরা।

ছিন্নমূল শিশুদের স্কুল ‘বন্ধু পাঠশালা’ প্রতিষ্ঠা করেছে রাউজান বন্ধুসভা
ছবি: বন্ধুসভা

সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের নিত্যদিনের ঘটনা। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ বন্ধুসভার বন্ধুরা বিভিন্ন সড়কের গতিরোধক চিহ্নিতকরণে রং করে দিয়েছেন। গত ২৯ ও ৩০ অক্টোবর গোয়ালন্দের প্রধান সড়কসহ চারটি গ্রামীণ সড়কের গতিরোধকে রং করা হয়। এ ছাড়া গাছে লাগানো বিভিন্ন ফেস্টুনের পেরেক তুলে দেওয়ার কাজও করেছেন। ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার বন্ধন আদর্শ বিদ্যালয়ে কোনো শহীদ মিনার ছিল না। ৩০ অক্টোবর কেরানীগঞ্জ বন্ধুসভার বন্ধুরা নিজস্ব অর্থায়নে সেখানে শহীদ মিনার নির্মাণ করে দিয়েছেন।

প্রতিবছরই প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে এই কর্মসূচি পালন করা হয়। প্রথম আলোর নামে রয়েছে প্রথম আলোর চর, প্রথম আলোর স্কুল, বন্ধু স্কুল, বন্ধু লাইব্রেরিসহ আরও কত-কী। বছরজুড়ে বন্ধুরা তাঁদের ভালো কাজের ধারা অব্যাহত রাখেন। নিজেদের অর্থায়নে প্রতিবছর অসহায় মানুষের মুখে সহমর্মিতার ঈদ কর্মসূচির মাধ্যমে হাসি ফোটান। পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ, বৃক্ষরোপণ, ডেঙ্গু প্রতিরোধ, বইমেলার আয়োজন, সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণ, মেডিকেল ক্যাম্প, শীতবস্ত্র বিতরণ, ত্রাণ বিতরণ, বিভিন্ন আত্মোন্নয়নমূলক কর্মশালা, নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানববন্ধন, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কর্মসূচি, ক্যারিয়ার-বিষয়ক কর্মশালা, সর্বোপরি সমাজ, রাষ্ট্র ও বৈশ্বিক যেকোনো অসংগতির বিরুদ্ধে বন্ধুরা প্রতিবাদ করেন।

সিলেট বন্ধুসভার একটি ভালো কাজ
ছবি: বন্ধুসভা

এ বছরও বন্ধুরা সহমর্মিতার ঈদ কর্মসূচির আওতায় ৩ হাজার ৪১০টি পরিবারকে ২৪ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৮ টাকা সহায়তা প্রদান করেছেন। ইউনিমেড ইউনিহেলথের সহযোগিতায় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সারা দেশে কাজ করেছেন। পুষ্টি-প্রথম আলো বিতর্ক উৎসব, শিখো-প্রথম আলো জিপিএ-৫ সংবর্ধনা-২০২৩- সহ অন্যান্য কর্মসূচি তো ছিলই। এ রকম অসংখ্য ভালো কাজের সাক্ষী বন্ধুসভার বন্ধুরা।

১১ নভেম্বর বাংলাদেশ শিশু একাডেমি মিলনায়তনে অনুষ্ঠেয় প্রথম আলো ও বন্ধুসভার রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে 'একটি করে ভালো কাজ'-এর সেরা তিনটি বন্ধুসভাকে সম্মাননা দেওয়া হবে। পাশাপাশি বৃক্ষরোপণে সেরা দশ, সহমর্মিতার ঈদে সেরা দশ ও পুরো বছরের কাজের ভিত্তিতে সেরা দশটি বন্ধুসভাকে সম্মাননা দেওয়া হবে।

বন্ধুরা চিত্তের বিকাশ ঘটানোর জন্য নাচ, গান, বই পড়া ও চলচ্চিত্র দেখার মাধ্যমে সংস্কৃতির চর্চা করেন। বন্ধুরা নিয়মিত পাঠচক্র করেন। শিল্প-সাহিত্য, খেলাধুলা, সংস্কৃতি, জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা করেন। বন্ধুরাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। আমাদের বন্ধুরা হারতে জানেন না। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলতে জানেন। বন্ধুসভা শেখায় কীভাবে নিজেকে আলোকিত করতে হয় এবং নিজের আলো দিয়ে চারপাশ উজ্জ্বল করতে হয়। বন্ধুদের হাত ধরে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ। বন্ধুসভার বন্ধুরা কাজ করেন বেশ, তাই হারবে না বাংলাদেশ।