কক্সবাজার বন্ধুসভা
রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন
কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দ্রুত মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো দরকার। কিন্তু প্রত্যাবাসন শুরুর আলামত দেখা যাচ্ছে না। প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হলে বাংলাদেশে শান্তিশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি জননিরাপত্তাও হুমকিতে পড়বে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দ্রুত কার্যকর করতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের আরও ভূমিকা রাখা দরকার। কারণ, রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশ সৃষ্টি করেনি। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ১৫ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে নজির স্থাপন করেছে।
কক্সবাজার বন্ধুসভার উদ্যোগে ‘রোহিঙ্গা সংকট ও সমাধানের উপায়’ শিরোনামে আলোচনা সভায় এ কথাগুলো বলেন বক্তারা। ২ মে বিকেলে প্রথম আলো কক্সবাজার অফিসে এটি অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সাধারণ সম্পাদক উলফাতুল মোস্তফার সঞ্চালনায় বন্ধুরা তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরেন।
সভাপতি ফাহিম কুদ্দুস বলেন, ‘১৯৭৮ সাল থেকে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শুরু। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে আট লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৩ লাখের বেশি। গত আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমার ফেরত নেয়নি। রাখাইন রাজ্যটিও এখন মিয়ানমার জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। রাখাইন রাজ্য দখল করে আছে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বিরোধ দীর্ঘদিনের। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অনেকটা কঠিন। আবার গত কয়েক মাসে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে আরও ১ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা। সংকট যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। রোহিঙ্গা সংকট কোন পথে এগোচ্ছে, আমরা জানি না।’
স্বাস্থ্য ও ক্রীড়া সম্পাদক জাহিদ হাসান বলেন, ২০১৭ সালে পালিয়ে আসা ৮ লাখ রোহিঙ্গাকে রাখার জন্য উখিয়া ও টেকনাফের ৭ হাজার একরের বেশি বনাঞ্চল ও পাহাড় ধ্বংস করে ৩৪টি আশ্রয়শিবির গড়ে তোলা হয়েছিল। বনাঞ্চল উজাড়, পাহাড়নিধনের ফলে পরিবেশ প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়। বনাঞ্চল উজাড়, প্রাকৃতিক জলাশয়, খাল-ছড়া ভরাট হওয়ায় হাতিসহ বন্য প্রাণীদের খাদ্য ও পানিসংকট দেখা দেয়। ধ্বংস হয় জীববৈচিত্র্য। আশ্রয়শিবির গড়ে তোলার কারণে ৫০টির বেশি বন্য হাতি টেকনাফ ও উখিয়ার বনাঞ্চলে আটকা পড়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আরও বিলম্বিত হলে পরিবেশের আরও ক্ষতি হবে।
পাঠাগার ও পাঠচক্র সম্পাদক কুলচুমা ইয়াসমিন বলেন, আশ্রয়শিবিরে প্রতিবছর গড়ে ৩৪ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিচ্ছে। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতিতে রোহিঙ্গা নারীদের অনীহা রয়েছে। অন্যদিকে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হওয়ায় নারী-শিশুরা পাচারের শিকার হচ্ছে। অপরাধে জড়াচ্ছে নারী-শিশুরা। আশ্রয়শিবিরে মাদকের বিস্তার যেমন বাড়ছে, তেমন খুনখারাবির ঘটনাও ঘটছে অহরহ। তাতে স্থানীয়রাও বিপদে। চুরি–ডাকাতি–ছিনতাইয়ে রোহিঙ্গারা জড়িয়ে পড়েছে।
সহসভাপতি আব্দুল নবী বলেন, বাংলাদেশে প্রথম রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৭৮ সালে। ১৯৯১ সালে ২ লাখ ৭৮ হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটলেও তখন ১ লাখ ৩৭ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে ২০১৭ সালে। তখন একসঙ্গে আট লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে। এখন আরও রোহিঙ্গা আসছে। কিন্তু সংকট সমাধানের উপায় দেখা যাচ্ছে না। দিন দিন পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করছে। কক্সবাজারের শ্রমবাজার এখন রোহিঙ্গা দখলে চলে গেছে। স্থানীয় আড়াই লাখ শ্রমজীবী মানুষ বেকার। তাই দ্রুত রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো দরকার।
বন্ধু হুমায়ুন কবির বলেন, সম্প্রতি মিয়ানমার সরকার ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যা একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। তবে বাস্তবায়নের পথে এখনো অনেক বাধা রয়ে গেছে। মিয়ানমারে রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা এবং রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকার না থাকা এই প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে। বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় নিরাপদ ও স্বেচ্ছামূলক প্রত্যাবাসনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সাধারণ সম্পাদক উলফাতুল মোস্তফা বলেন, সংকটের স্থায়ী সমাধানে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন। রাখাইন রাজ্যে এখনো অস্থিরতা বিদ্যমান। রোহিঙ্গারা যে জায়গায় থাকত, সেই জায়গাটা এখন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে চলে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা কঠিন। তবে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল চাপ প্রয়োগ করলে মিয়ানমারের জান্তা সরকার এবং আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের গ্রহণে সম্মতি জানাতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে আরও তৎপর হতে হবে।
সভায় আরও বক্তব্য দেন সহসভাপতি নুরুল আবচার, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মারগুম মোর্শেদ, পরিবেশ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন, দুর্যোগ ও ত্রাণ সম্পাদক তায়েফ বিন কাদের, জেন্ডার ও সমতাবিষয়ক সম্পাদক শাহরিয়া আলম, ম্যাগাজিন সম্পাদক মাহিয়া রহমান, বন্ধু আফরিদ কুদ্দুস, কক্সবাজার সিটি কলেজ বন্ধুসভার সভাপতি সাইফুল ইসলাম প্রমুখ।
সভাপতি, কক্সবাজার বন্ধুসভা