হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন আবেদ আলী মণ্ডল (৬৩)। নিজে নিজেই অক্সিজেন নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এক থেকে দুই মিনিট নেওয়ার পর আবার নিজ থেকে বন্ধ করছেন। কোনোভাবেই যেন নিজেকে সামলাতে পারছেন না। পাশে সাত বছর বয়সী নাতির নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া করার যেন কিছুই নেই। ২৪ মার্চ রাত ৯টার দিকে এমনই দৃশ্য দেখা যায় রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
আবেদ আলী গোয়ালন্দ উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের নতুনপাড়ার বাসিন্দা। কয়েক বছর ধরে ফুসফুস ছিদ্র হওয়াসহ শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। চিকিৎসা করাতে নিজের সামান্যটুকু জমি ও ভিটেবাড়ি বিক্রি করেছেন। এখন গোয়ালন্দ পৌরসভার বদিউজ্জামান ব্যাপারীপাড়ার একজনের পরিত্যক্ত বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। ঘরে স্ত্রী আঁখি বেগমও দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। একমাত্র ছেলে আশিক মণ্ডল জেলার পাংশা উপজেলায় শ্রমজীবী হিসেবে কষ্টে দিন পার করছেন। দুই মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দিলেও তাঁদেরও আর্থিক অনটনে দিন কাটছে। এমন অবস্থায় আবেদ আলীর পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই।
গোয়ালন্দ বন্ধুসভার বন্ধুরা আসন্ন পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ‘সহমর্মিতার ঈদ’ কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে সন্ধান পান আবেদ আলীর। গতকাল সোমবার রাতেই হাসপাতালে ছুটে যান বন্ধুরা। আবেদ আলীর চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসার দায়িত্বভার নেন এবং আবেদ আলীর হাতে তুলে দেন কিছু টাকা। এ সময় গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) শরীফ ইসলাম, প্রথম আলো রাজবাড়ী প্রতিনিধি এম রাশেদুল হক, গোয়ালন্দ বন্ধুসভার সভাপতি জীবন চক্রবর্তী, সহসভাপতি মইনুল হক মৃধা, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সফিক মণ্ডল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আবেদ আলীর স্ত্রী আঁখি বেগম বলেন, নিজের প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ জমি ছিল। নিজের ও স্বামীর চিকিৎসা করাতে বিভিন্ন ব্যক্তির থেকে সুদে ধার নেন এবং এনজিও থেকে ঋণ নেন। এসব টাকা পরিশোধ করতে এবং চিকিৎসা করাতে শেষ সম্বল ভিটেটুকু আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি করেন। এখন অন্যের বাড়িতে আশ্রিতা হিসেবে আছেন। এখনো অনেক টাকা দেনা আছেন। স্বামীর চিকিৎসা, পাওনাদারের চাপ এবং সংসার কীভাবে চলবে, সেই চিন্তায় দিন দিন আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
হাসপাতালের আরএমও শরীফ ইসলাম বলেন, ‘১৮ মার্চ সকালে আবেদ আলী হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর সিওপিডি বা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ হলো ফুসফুসের তীব্র প্রদাহজনিত রোগ হয়েছে। যার ফলে ফুসফুসে ঠিকমতো বায়ু পরিবাহিত হতে পারে না। সারা বিশ্বে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ এটি। মাঝেমধ্যে এ রোগটির উপসর্গ বেড়ে যায়। এই রোগ কখনো পুরোপুরি সেরে যায় না। এ জন্য অনেক ব্যয়বহুল চিকিৎসার প্রয়োজন। কিন্তু তাঁর সেই সামর্থ্য বা লোকবল নেই। আমরা হাসপাতাল থেকে সাধ্যমতো চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি। দিন দিন স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হচ্ছে। ভালো চিকিৎসা করাতে না পারলে বড় ধরনের বিপদ ঘটতে পারে। বন্ধুসভার সদস্যরা তাৎক্ষণিকভাবে এগিয়ে আসায় ধন্যবাদ জানান।’
গোয়ালন্দ বন্ধুসভার সভাপতি জীবন চক্রবর্তী বলেন, ‘সহমর্মিতার ঈদ কর্মসূচি বাস্তবায়নে অসহায় মানুষকে খুঁজতে গিয়ে প্রথম আলো রাজবাড়ী প্রতিনিধি এম রাশেদুল হক আবেদ আলীর সন্ধান পান। তাৎক্ষণিক প্রতিনিধিসহ আমরা হাসপাতালে ছুটে যাই। সাধ্য অনুযায়ী আর্থিক সহযোগিতা করেছি। চিকিৎসার খোঁজখবর রাখব। চিকিৎসা করাতে যে অর্থের প্রয়োজন, এত টাকার জোগান আমাদের পক্ষে দেওয়া কষ্টসাধ্য। তাই আবেদ আলীর চিকিৎসার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানাচ্ছি।’