পাঠচক্রে ‘বাঙালি মুসলমান সমাজের সংস্কৃতি ভাবনা’

মেহেরপুর বন্ধুসভার পাঠচক্র
ছবি: বন্ধুসভা

২৫ জুন বৃষ্টিভেজা সকালে মেহেরপুর সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সেমিনারকক্ষে আবদুল্লাহ আল আমিনের লেখা ‘বাঙালি মুসলমান সমাজের সংস্কৃতি ভাবনা’ বই নিয়ে পাঠের আসরে বসেন মেহেরপুর বন্ধুসভার বন্ধুরা।

আসরে বইটির নানা দিক তুলে ধরে বক্তব্য দেন লেখক আবদুল্লাহ আল আমিন, মেহেরপুর বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক তানিয়া হক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম, লিখন মিয়া, ফারজানা ইয়াসমিন, নাফিউল ইসলাম, মৃদুল হাসান, ফয়সাল হোসেন প্রমুখ।

বাঙালি মুসলমান সমাজের উত্থান পর্বের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে বইয়ের লেখক বলেন, উনিশ শতকে রামমোহন, দ্বারকানাথ, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র—বিরাট সব রথী-মহারথীর মননচর্চার হাত ধরে হিন্দু সমাজের যখন ঘুম ভাঙছে; বাঙালি মুসলমান বিশেষত, পূর্ববাংলার বিশাল জনগোষ্ঠী তখনো কাদামাটিতে উবু হয়ে রুয়ে চলেছে ধানের চারা। আবার কেউ কেউ খালের পাড়ের মক্তব-মাদ্রাসায় আমপারা পড়ছে গভীর নিমগ্নতায়। বাঙালি মুসলমান সমাজে উনিশ শতকে কোনো রেনেসাঁস বা জাগরণ ঘটেনি, যেমন ঘটেছিল ওপরতলার শিক্ষিত বর্ণহিন্দু ও ব্রাহ্মদের মধ্যে। তাই এ সমাজে কোনো রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, জগদীশ বসু জন্মগ্রহণ করেননি। তারপরও হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো বিশ শতকের তৃতীয় দশকে আবির্ভূত হন নজরুল। তাঁর রক্তমাতাল কবিতা-গান বাংলার তরুণ চিত্তে উন্মাদনা সঞ্চার করে। প্রেম ও দ্রোহের এক অমোঘ আবর্তনে দলে দলে মানুষ, বিশেষত তরুণ সমাজ নজরুলকে ঘিরে অনুপ্রাণিত ও ঐক্যবদ্ধ হন।

তিনি বলেন, বাঙালি মুসলমান সমাজের প্রভাবশালীরা নজরুলকে আন্তরিকভাবে বরণ করে নিতে পারেননি। তাঁকে তেমন গুরুত্বও দেওয়া হয়নি। অনেকেই বাঙালি মুসলমান সমাজে জ্ঞানের দীপশিখা জ্বেলে দূর করতে চেয়েছেন গাঢ় আঁধার, কিন্তু পারেননি। শিখা গোষ্ঠীর তরুণ তুর্কিরাও আলো জ্বালতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সমর্থ হননি। আমাদের সমাজে জাগরণ ঘটতে শুরু করে মূলত ১৯৬০-এর দশকে। বায়ান্নে ‘রাঙা হৃদয়ের বর্ণলেখায়’ নিজেকে সজ্জিত করে ষাটের দশকেই ‘গায়ে কাদামাটি লেপটানো উবু হয়ে থাকা’ পূর্ববাংলার মুসলমান সমাজ মাথা তুলে দাঁড়ায়। চালাঘর থেকে তারা বেরিয়ে আসে উন্মুক্ত আকাশের নিচে। তরুণেরা পরিচিত হয় বিশ্ব সাহিত্য-শিল্প-দর্শন-নন্দনতত্ত্ব ও রাজনীতিবিজ্ঞানের সঙ্গে। এমনকি নতুন করে পাঠ গ্রহণ করে চিরায়ত বাংলা সাহিত্যের, যা আমাদের চিত্তে জাগরণ ঘটিয়ে চলেছিল। বৈরী পরিবেশের মধ্যেও তৎকালীন পূর্ববাংলার মুসলমান তরুণেরা চিনে নেন জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্তর কবিতা; অবনীন্দ্রনাথ-যামিনী রায়-নন্দলাল বসুর চিত্রকলা, সত্যেন বোস-জগদীশ বসুর বিজ্ঞানচর্চা, পণ্ডিত রবিশঙ্করের সেতারসহ আরও কত কিছুর সঙ্গে। এভাবেই বাঙালি মুসলমান আত্মপরিচয়ের সন্ধান পেয়ে বিস্মিত হয়। স্বপ্ন ও সৃষ্টিশীলতার আবেশ মাখানো চোখে প্রথমবারের মতো চোখ মেলে আকাশ ও মাটির পানে। ইতিহাসের পাতা ফুঁড়ে পায়ের তলায় জেগে ওঠে এক নতুন জমিন। এরপর বাংলার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে বইতে থাকে আন্দোলনের মাতাল-হাওয়া। সবাইকে নিয়ে, প্রাণে প্রাণে মিলিত হয়ে বাঙালি মুসলমান সৃষ্টি করে এক নতুন ইতিহাস, নতুন ভূগোল।

লেখক আরও বলেন, শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে স্বাধীনতা আসে। কিন্তু মুক্তি আসেনি। ইতিহাসের পথ বেয়ে আবার যেন ফিরে আসছে পুরোনো অন্ধকার, হতাশা ও অবক্ষয়। কারা যেন ডুবিয়ে দিতে চাইছে আমাদের ভালোবাসার মিলনতরি। মুছে ফেলতে চেয়েছে লড়াইয়ের সব চিহ্ন, সব স্মারক—জাতির অভ্যুদয়ের গৌরবগাথা। বাংলাদেশ ক্রমশ হয়ে উঠছে মুক্তচিন্তা, বাক্‌স্বাধীনতা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও শিল্পকলাবিরোধী দূষিত ভূখণ্ড। বিজ্ঞানপড়ুয়া তরুণেরাও কখনো কখনো পথ হারিয়ে ফেলছেন। তাঁরা যেন তলিয়ে যেতে চাইছেন ভোগবাদিতা আর যুক্তিহীনতার অতল তলে।

ফারজানা ইয়াসমিন বলেন, ১৯৪৭-এর ভ্রান্ত রাজনীতি বাঙালি মুসলমানকে উদ্বাস্তু ও ক্ষত-বিক্ষত করেছে। তাঁর মহৎ ভাবনাগুলো উপড়ে ফেলতে চেয়েছে। কিন্তু পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের মাটিলগ্ন মানবিক রাজনীতির পরশে জেগে ওঠে বাঙালি মুসলমান। তারা এক নতুন পথের সন্ধান পায়। সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার সীমা পেরিয়ে তারা আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে। নতুন করে জেনে নেয় রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ও বাঙালি আধুনিকদের। তার চিত্তে ফুটে উঠতে থাকে বাঙালি সংস্কৃতির মহৎ ভাবনাগুলো ভিন্নমাত্রিক ব্যঞ্জনায়।

রিয়াজুল ইসলাম বলেন, আয়ুব খানের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের মধ্যেও রবীন্দ্র-নজরুলের গানে-কবিতায় পূর্ববাংলার গ্রাম ও শহর মুখর হয়ে ওঠতে থাকে। সংস্কৃতির অবিনাশী চেতনা ধারণ করে বাঙালি মুসলমান সামনের দিকে এগিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশের। নতুনভাবে জন্ম লাভ করে বাঙালি মুসলমান।

তানিয়া হক বলেন, ‘আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু আদর্শিকভাবে দাঁড়াতে পারিনি। যে স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের উজ্জ্বল অভ্যুদয়, তা আজও পূরণ হয়নি। লেখকের মতো আমার ভেতরেও প্রশ্ন জাগে, আমরা কি অসহিষ্ণুতা, ভ্রান্তির ঘোর আঁধারে পথ হারিয়ে ফেলব? আমাদের চৈতন্য কি আলোড়িত হবে না মাটি ও আকাশের গানে?

বন্ধু, মেহেরপুর বন্ধুসভা