চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আমনুরা রেলওয়ে সুইপার কলোনি (হরিজন পল্লি)। এখানে বসবাসকারী ২০টি পরিবারের সদস্যরা সামাজিক বৈষম্যের শিকার। নিচু জাতের ট্যাগ দিয়ে তাঁদের সঙ্গে কেউ চলাফেরা করে না; এমনকি হোটেল-রেস্তোরাঁয় বসে তাঁদের খাবার খেতেও দেওয়া হয় না। তাই তাঁরা বাস করেন দুঃখ ও মনকষ্ট নিয়ে।
তাঁদের এই দুঃখ-কষ্ট ভরা জীবনের গল্প ব্যথিত করেছে বন্ধুসভার বন্ধুদের মন। তাঁদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন ও সমাজের এমন বৈষম্য ভাঙতে এসব মানুষের সঙ্গে ‘এক জলেই সব হয় গো শুচি’—লালনের এই চরণ সামনে রেখে আয়োজন করা হয় আনন্দ-আড্ডা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ভূরিভোজের। ২৫ অক্টোবর দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বন্ধুসভা। প্রথম আলোর ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ‘একটি ভালো কাজ’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে এটি ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ বন্ধুসভার এ বছরের শততম আয়োজন।
এদিন সকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর থেকে ট্রেনে করে বন্ধুরা আমনুরায় পৌঁছান। স্থানীয় বাজার থেকে রান্নার সব উপকরণ কিনে দলবেঁধে কলোনিতে যান তাঁরা। বন্ধুদের দেখে বেশ উচ্ছ্বসিত ছিল কলোনির ছোট ছোট শিশু ও কিশোর। কলোনির ছোট্ট মেয়ে বৃষ্টি মন্দিরের পাশের শিউলিগাছের নিচে ফুল কুড়াচ্ছিল। বন্ধুসভার বন্ধুদের দেখতে পেয়ে আনন্দে দৌড়ে আসে সে। হাতে ধরা সাদা-কমলা শিউলি ফুল দিয়ে সে শুভেচ্ছা জানায় বন্ধুসভার দুই উপদেষ্টা ও উপস্থিত অন্য বন্ধুদের। বৃষ্টির এই সরল ও আন্তরিক ভালোবাসায় মুগ্ধ হয় উপস্থিত সবাই।
রান্নার উপকরণ কেটেছেঁটে প্রস্তুত করেন পল্লির তরুণেরা, রান্নাও করেন তাঁরাই। এরপর দুপুরে সবাই একত্রে মিলেমিশে খাবার খেয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন।
রান্নার পাশাপাশি চলে গল্প-আড্ডা, লালনের গান ও লোকসংগীত। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ‘বাউল ভক্তকুল’-এর কাওসার রিপন লালনের গান পরিবেশন করেন, ব্যাঞ্জো বাজিয়ে সহযোগিতা করেন আবদুর রাকিব। বন্ধুসভার উপদেষ্টা আবদুস সাত্তার ও বন্ধু রমিজ অন্তরও লোকগান পরিবেশন করেন। গানের তালে তালে নাচে যোগ দেন বয়স্ক নারী ফুরকুনি ভুঁইমালী, বৃদ্ধ লোটেন ভুঁইমালী, পল্লির শিশু ও বন্ধুসভার সদস্যরা। নাচ-গানের ছন্দে চারদিক দুলে ওঠে; দিনের রোদের ঝলকানিতে পরিবেশটা আরও উজ্জ্বল ও আনন্দে ভরে যায়।
এরপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন পল্লির মোড়ল নগেন বাঁশফোড়, বন্ধুসভার উপদেষ্টা আবদুস সাত্তার, আনোয়ার হোসেন ও সভাপতি আরাফাত মিলেনিয়াম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জাগো নারী বহ্নিশিখার সভাপতি ফারুকা বেগম, সাধারণ সম্পাদক মনোয়ারা খাতুন, উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি হিংগু মুরমু, বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের জেলা সভাপতি রাজেন হরিজন, সাংগঠনিক সম্পাদক মধুমঙ্গল দাস ও উপদেষ্টা রথিন দাস।
প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে নগেন বাঁশফোড় বলেন, ‘দিনটি পল্লির লোকজন প্রাণভরে উপভোগ করেছে। শিশুকিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধরাও আনন্দ-উল্লাসে অংশগ্রহণ করেছে। আমরা নিজেদের সম্মানিত বোধ করেছি। আমার মনটা ভরে গেছে। দিনটি আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
বন্ধুসভার সভাপতি আরাফাত মিলেনিয়াম বলেন, ‘সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠানটি ছিল আমাদের একটি প্রতীকী প্রতিবাদ। এটি বছরের শততম কর্মসূচি ও একটি ভালো কাজের অংশ। হরিজনপল্লির মানুষের সঙ্গে দিনটি দারুণ কেটেছে। বন্ধুদের জীবনে এটি স্মরণীয় ও শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে।’
কর্মসূচিতে আরও উপস্থিত ছিলেন বন্ধুসভার সহসভাপতি ফারাহ উলফাৎ রহমান, সাধারণ সম্পাদক মাসরুফা খাতুন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাফিউল হাসান, সহসংগঠনিক সম্পাদক জাহিদ হাসান, অর্থ সম্পাদক আলীউজ্জামান নূর, দপ্তর সম্পাদক উৎস আসেফ, পরিবেশ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক রাকিবুল হাসান, কার্যনির্বাহী সদস্য শাকিল হোসেন ও আহমেদ ওয়ালিদ; বন্ধু রমিজ আহমেদ, সাবরিন আখতার, শাকিলা খাতুনসহ অন্য সদস্যরা।
সাধারণ সম্পাদক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ বন্ধুসভা