ভীতি দূরে ঠেলে শিক্ষার্থীরা গণিতকে আনন্দপাঠে পরিণত করেছে

দিনাজপুরে অনুষ্ঠিত হলো ডাচ্–বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো ২৩তম আঞ্চলিক গণিত উৎসবছবি: বন্ধুসভা

উত্তরের কনকনে শীত ও ঘন কুয়াশাকে উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীদের ঢল নামে দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট মাঠে। হিমেল হাওয়া তাদের উচ্ছ্বাসকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাদের মুখে ফুটে ওঠে গণিতের ভয়কে জয় করার অভীষ্ট লক্ষ্য।

১৭ জানুয়ারি ‘গণিত শেখো, স্বপ্ন দেখো’ স্লোগানে দিনাজপুরে অনুষ্ঠিত হলো আঞ্চলিক গণিত উৎসব ২০২৫। ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় গণিত উৎসবের আয়োজন করছে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি। সার্বিক সহযোগিতায় ছিল দিনাজপুর বন্ধুসভা।

জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ওয়াদুদ মন্ডল। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের ছেলেমেয়েরা সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতির সঙ্গে আছে। যেখানে মুখস্থবিদ্যাকে দূরে ঠেলে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্যে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মেধাবিকাশ ও সামাজিক উন্নয়নে গণিত অলিম্পিয়াডের আয়োজন একটি সৃজনশীল প্ল্যাটফর্ম।’

বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করেন ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক দিনাজপুর শাখার উপব্যবস্থাপক মোস্তফা হেলাল সুজন। তিনি বলেন, ‘বাস্তব জীবনের সব সমস্যার সমাধান হয় গণিতের হাত ধরে। এই উৎসবে ক্রমেই শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আগ্রহ বাড়ছে। ভীতি দূরে ঠেলে আজকে শিক্ষার্থীরা গণিতকে আনন্দপাঠে পরিণত করেছে।’

আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করেন দিনাজপুর জিলা স্কুলের সহকারী শিক্ষক শাহজাহান সাজু। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘গণিত হচ্ছে সব বিজ্ঞানের প্রাথমিক পাঠ। পৃথিবীর সব কার্যক্রম পরিচালিত হয় গণিতের সংস্পর্শে। যত ধরনের বিজ্ঞান আছে, সব কটিই দাঁড়িয়ে আছে গণিতের ওপর। আমরা বিজ্ঞানে ভালো নই, মানে আমরা গণিতে ভালো নই। প্রথম আলো তাদের দায়বদ্ধতা থেকে গণিতের চর্চা বাড়াতে নিয়মিত এ ধরনের আয়োজন করে আসছে। আমরা প্রথম আলো ও ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে কৃতজ্ঞ।’

উৎসবে অংশ নেয় দিনাজপুর, ঠাঁকুরগাও, পঞ্চগড় ও জয়পুরহাট জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাড়ে চার শ শিক্ষার্থী। এবারের উৎসবে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে পীরগঞ্জ আলহাসানাহ্ স্কুল থেকে। প্রাথমিক ধাপে নির্বাচিত ৬২ জন শিক্ষার্থী নিয়ে আসেন শিক্ষক খালেসুর রহমান। কথা বলে জানা যায় এটিই ছিল তাদের শিক্ষার্থীদের প্রথম অংশগ্রহণ। অনুভূতির কথা জানতে চাইলে খালেসুর রহমান বলেন, ‘গণিত অলিম্পিয়াড নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। শিক্ষার্থীদের গণিতের প্রতি যে ভয়ভীতি রয়েছে, তা দূর করার একটি চমৎকার আয়োজন।’

উৎসবের সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন দিনাজপুর বন্ধুসভার বন্ধুরা
ছবি: বন্ধুসভা

স্কুলটির শিক্ষিকা হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যত এই ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে, ততই তাদের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পাবে।’

উদ্বোধন শেষে বন্ধুসভার বন্ধুদের সহযোগিতায় সারিবদ্ধভাবে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রবেশ করে। সকাল ১০টায় শুরু হয় পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষে বন্ধুসভার বন্ধুদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষার্থীদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক মামুনুর রশিদ, দিনাজপুর সরকারি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আবদুস সালাম ও দুপ্তইর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক একরামুল হক প্রমুখ।

উৎসবে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি উৎসুক ছিল অভিভাবকেরাও। জয়পুরহাট জেলা থেকে আসা অভিভাবক রবিউল হক (৫০) বলেন, ‘আমার মেয়ে গতবার জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারজয়ী হয়েছে। তাই আমি সেই আগ্রহের জায়গা থেকে এবারও মেয়েকে নিয়ে এসেছি। উৎসবে অংশগ্রহণের আনন্দ আমাদের ভুলিয়ে দিয়েছে আজকের শীত। আমার মেয়ে যতটা উদ্দীপনা নিয়ে এসেছে, আমিও ঠিক ততটাই উচ্ছ্বসিত।’

হিমালয়কন্যা পঞ্চগড় থেকে আসা তপন রায় (২৫) বলেন, ‘আমি আমার ছোট ভাইকে নিয়ে গতকালকই এসেছি; যেন সে ঠিক সময়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে। আমি চাই আমার ভাই নিজেকে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে নিজের অবস্থানটি চিহ্নিত করুক এবং গণিতের প্রতি তার ভয় দূর হোক।’

ঠাকুরগাঁও থেকে আসা অভিভাবক গায়ত্রী রায়ের (৪০) সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছেলেকে নিয়ে প্রথমবারের মতো এমন আয়োজনে এসে অনেক আনন্দিত তিনি। গণিতের প্রতি ছেলের আগ্রহের জায়গা থেকেই মূলত এখানে আসা।

আয়োজন শেষে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। চারটি ক্যাটাগরিতে জাতীয় পর্বের জন্য নির্বাচিত হয় মোট ৪৯ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে প্রাইমারি ৮ জন, জুনিয়র ২৮ জন, সেকেন্ডারি ১১ জন এবং হায়ার সেকেন্ডারি ২ জন।

ম্যাগাজিন সম্পাদক, দিনাজপুর বন্ধুসভা