তারুণ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার জরুরি

ইউএনডিপি-ইউএনইপি পোভার্টি-এনভায়রনমেন্ট অ্যাকশনের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথম আলো ও প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পর্বের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) ফকরুল আহসান, মতিউর রহমান, গোয়েন লুইস, শামসুল আলম, সাজেদা সাথী ও ভ্যান গ্যুয়েন। গতকাল রাজধানীর কেআইবি মিলনায়তনেছবি: প্রথম আলো

দেশের জনসংখ্যার বড় অংশ কর্মক্ষম তরুণ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে এই জনগোষ্ঠীর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয় লিঙ্গ, দলিত, চা-শ্রমিক, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মতো সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় যুক্ত করার ক্ষেত্রে এখনো বাধা রয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দর্শন বাস্তবায়ন করতে হলে এসব বাধা দূর করা জরুরি।

‘এসডিজি প্রচারাভিযান-২০২২: যুব ও নারীদের বলিষ্ঠ প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক প্রচারাভিযানের জাতীয় পর্বের অতিথিরা এসব কথা বলেন। ইউএনডিপি-ইউএনইপি পোভার্টি-এনভায়রনমেন্ট অ্যাকশনের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথম আলো ও প্রথম আলো বন্ধুসভা ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর খামারবাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন (কেআইবি) মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, দেশের জনগোষ্ঠীর বর্তমান গড় বয়স ৩৮ বছর। কর্মক্ষম এই জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে ‘জনসংখ্যার বোনাস’–এর সুযোগ নিতে হবে৷ সরকার ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তরুণদের কর্মসংস্থানকে গুরুত্ব দিয়েছে।

বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) বাস্তবায়নে ভালো করেছিল উল্লেখ করে শামসুল আলম বলেন, এমডিজির ধারাবাহিকতায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) এসেছে। এসডিজি বাস্তবায়নে যুবসমাজ সম্ভাবনাময় শক্তি।

জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইস বলেন, কর্মসংস্থানে বাংলাদেশ পিছিয়ে। শোভন কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে। দক্ষ জনশক্তি হিসেবে তরুণদের কাজে লাগাতে হবে। তাঁদের উন্নয়নের ধারায় যুক্ত করতে সরকারি-বেসরকারি অংশীজনদের সঙ্গে কাজ করছে ইউএনডিপি। সমাজের সব শ্রেণির অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমেই শুধু উন্নয়নকে টেকসই করা সম্ভব।

দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সমন্বিতভাবে কাজ করার বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন ইউএনডিপি বাংলাদেশের উপ–আবাসিক প্রতিনিধি ভ্যান গ্যুয়েন বলেন, বাংলাদেশে তরুণ গোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি। তরুণদের একটি বড় অংশ, বিশেষ করে মেয়েরা কর্মসংস্থানের বাইরে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তরুণ নেতৃত্ব ও তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।

সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়ী বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সদস্য সাজেদা সাথী বলেন, শুরুতে গ্রামের মানুষ মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে নেতিবাচক কথা বলত। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। মেয়েদের সুযোগ দিতে হবে।

উন্নয়নের ধারায় নারীকে যুক্ত করা না গেলে এসডিজি অর্জন কষ্টসাধ্য হবে বলে মনে করেন ইউএনডিপির প্রধান কারিগরি উপদেষ্টা ফকরুল আহসান। তিনি বলেন, এসডিজি প্রচারাভিযানে নারী ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, গত কয়েক বছরে দেশের কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্য খাতে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তবে বৈষম্য, বেকারত্ব, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বেশ কিছু সমস্যাও রয়ে গেছে। সুশাসনের সমস্যা রয়েছে, দুর্নীতি আছে, রাজনীতিতেও সংকট রয়েছে। ধীরে ধীরে এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে তরুণদের অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।

পরে মুক্ত আলোচনায় তৃতীয় লিঙ্গের নারী রোহিণী বলেন, ‘আমরা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নই। আমাদের পিছিয়ে রাখা হয়েছে। সুযোগ পেলে আমরাও দেশকে গর্বিত করতে পারব।’

লাক্কাতুরা চা-বাগানের চা-শ্রমিকের সন্তান মিতা গোয়ালা বলেন, চা-শ্রমিকের সন্তানেরা এখনো লেখাপড়ার পর্যাপ্ত সুযোগ পায় না। সাধারণের চেয়ে চা-বাগানের জীবনমান কেন খারাপ থাকবে।

বান্দরবানের প্রীতম তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘আদিবাসীদের এখনো ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বা অন্য নামে ডাকা হয়। সরকার কেন আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেবে না।’

মানসিকতার বদল প্রয়োজন

প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হকের সঞ্চালনায় প্যানেল আলোচনা পর্বে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার অ্যান্ড উইমেন স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, দক্ষতার অভাব, কর্মক্ষেত্রে নিপীড়ন এবং মজুরিবিহীন সেবাকাজ—এই তিনটি বিষয় নারীর কর্মসংস্থানের বড় বাধা।

ইউএনডিপি বাংলাদেশের সিনিয়র গভর্ন্যান্স স্পেশালিস্ট শীলা তাসনীম হক বলেন, আগামী সাড়ে তিন বছরে ১০ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি, বিশেষ করে নারীদের তৈরি করতে উদ্যোগ নিয়েছে ইউএনডিপি।

মনস্তাত্ত্বিক বৈষম্য দূর করা না গেলে এসডিজির মাধ্যমে বৈষম্য দূর করা যাবে না বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম।

চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন খান বলেন, পরিবেশবিষয়ক আন্দোলন স্বল্পোন্নত দেশগুলো থেকে শুরু হওয়া দরকার। সব উন্নয়ন দর্শন হতে হবে প্রকৃতিকে রক্ষা করে।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তৃতা করেন বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি উত্তম রায়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ইউএনডিপির এসসিফোর এসডিজি প্রকল্প সহযোগী ফারহানা রাজ্জাক ও বন্ধুসভার জাতীয় পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক জাফর সাদিক।

অনুষ্ঠানে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এতে চ্যাম্পিয়ন হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রানার্সআপ বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়।

পরে এসডিজি নিয়ে রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। এতে প্রথম হন আশরাফী বিনতে আকরাম। বিভিন্ন বিভাগের প্রতিনিধি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও বন্ধুসভার সদস্যদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়।

এর আগে দুই মাস ধরে প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও সিলেটে বিভাগীয় অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এসব অনুষ্ঠানে সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তি, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর যুব প্রতিনিধি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা প্রায় ১ হাজার ২০০ যুব ও যুব নারী অংশ নেন।