যুগ থেকে যুগান্তর ছাপা বইয়ের আবেদন থাকবে

বইমেলায় পছন্দের বই দেখছেন শিক্ষার্থীরা
ছবি: প্রথম আলো

‘মেলা’ শব্দটি শুনলেই আমরা বুঝতে পারি, যেখানে অনেক মানুষের সমাহার। মেলা মিলিয়ে দেয় মানুষের সঙ্গে মানুষকে, দেশের সঙ্গে দেশকে। এই মিলনের মাধ্যমেই আমরা চিনতে পারি মানুষ, দেশ, শিল্প, সংস্কৃতি ও সমাজকে। তবে মেলা তো নানা রকমের হয়। মেলা পণ্যেরও হয় আবার জ্ঞান আহরণেরও হয়। জ্ঞান আহরণের অন্যতম মাধ্যম হলো বই। বইমেলা বইয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়ায়। মেলা শুরু হলে বই কেনার প্রতি বিশেষ তাগিদ অনুভব করি আমরা। তা ছাড়া দূরদূরান্ত থেকে বহু প্রকাশক আসেন বইমেলায়। সবকিছু মিলেই বইমেলা পাঠকদের কাছে অন্য রকম এক আবেগের জায়গা দখল করে রেখেছে।

১ অক্টোবর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমা প্রকাশনের আয়োজনে ছয় দিনব্যাপী বইমেলা শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই মেলায় সহযোগিতা করছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা। বিকেল পৌনে চারটায় মিলনায়তনের সেমিনারকক্ষে মেলার উদ্বোধন করেন লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রব্বানী।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মনির উদ্দিন শিকদার, প্রথমা প্রকাশনের সমন্বয়ক জাবেদ হুসেন, অন্য আলোর সম্পাদক আলতাফ শাহনেওয়াজ, প্রথমা প্রকাশনের ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন, কর্মকর্তা মেরিনা ইয়াসমিন, প্র-প্রকাশক সুমন্ত আসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে আমন্ত্রিত অতিথিরা
ছবি: প্রথম আলো

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক গিয়াসউদ্দিন মুন্নার সঞ্চালনায় লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘প্রাকৃতিক পরিবেশের চমৎকার একটি ক্যাম্পাস জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে পড়াশোনা করা অনেকের সঙ্গেই আমার চেনাজানা রয়েছে। রাজনীতি নিয়ে তরুণদের একটা আগ্রহ রয়েছে। রাজনীতি নিয়ে সবারই ন্যূনতম সচেতনতা থাকা জরুরি। রাজনীতি মানে কোনো নির্দিষ্ট দল করতে হবে, এমন নয়। রাজনীতি মানে রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা রাখা, জ্ঞান রাখা বা সচেতন থাকা। রাজনীতির বিষয়ে কারও আগ্রহ থাকলেই যে কোনো দলের ওপর আগ্রহ থাকতে হবে, বিষয়টি এমন নয়।’

মহিউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, ‘আমার বইয়ে মাঝেমধ্যে কিছু ভুল থাকে, যা পরবর্তী মুদ্রণে সংশোধন করে দিই। তাই আপনারা আমার বইয়ে ভুল পেলে আমাকে মেইলে জানাবেন। কারণ, এভাবে আমি লেখক ও পাঠকের সঙ্গে একটা যোগাযোগ গড়ে তুলতে চাই। এতে লেখার গুণগত মান বাড়ে এবং লেখায় একটা প্রবৃত্তি তৈরি হয়। আসলে ভুল এড়ানোর সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে কিছু না লেখা। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। লেখকেরা বই লেখেন, প্রকাশক সেটা প্রকাশ করেন। অনেক সময় অনেক প্রকাশক বই ছাপাতে লেখকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকেন। এত কিছুর পরও যাঁরা পকেটের পয়সা খরচ করে বই কিনছেন, তাঁদেরকে আমার কাছে দেবদেবী মনে হয়!’

প্রথমা প্রকাশনের সমন্বয়ক জাবেদ হুসেন বলেন, একটা সময় মানুষ পণ্ডিতদের কাছ থেকে জ্ঞান নিয়ে মুখস্থ রাখতেন। এরপর ইউরোপে ব্যাপক আকারে বই পড়া শুরু হয়। তখন ওই পণ্ডিতেরা হাহুতাশ করা শুরু করেন যে মানুষজন আর মুখস্থ রাখছেন না, সবাই বই পড়া শুরু করছেন। আবার ঠিক এখন বর্তমান সময়ে এসে এমন হচ্ছে যে মানুষজন ছাপা বই পড়ছেন না বলে হাহুতাশ করছেন। কালে কালে, যুগ থেকে যুগান্তরে মানুষের জ্ঞানচর্চার ধরন বা মাধ্যম পরিবর্তন হয়। ছাপা বই পড়া তার মধ্যে একটা মাধ্যমমাত্র। নিজেকে খুঁজে পাওয়ার অন্যতম একটা মাধ্যম হলো বই। যদি নিজেকে বুঝতে চান, জানতে চান, যেমন করে পৃথিবীতে জন্মেছেন, তেমন করে যদি না মরতে চান, তাহলে বই পড়তে হবে। বই পড়া শুরু করলেই কেবল জানতে পারবেন, কত কিছু জানার বাকি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমার বইমেলা
ছবি: প্রথম আলো

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী বলেন, সভ্যতা থেকে সভ্যতা, যুগ থেকে যুগান্তর—ছাপা বইয়ের আবেদন থাকবে। সুতরাং বইয়ের কাছে মানুষের ফিরে আসতেই হবে। সুন্দরকে জানা, সুন্দরকে দেখার অন্যতম একটি মাধ্যম হলো বই। সমাজ, পৃথিবী, রাষ্ট্র, সভ্যতাকে জানার জন্য হলেও বই পড়তে হবে। পড়ালেখার বিকল্প নেই। এই রাষ্ট্রকে আমূল পরিবর্তন করা দরকার। আর সেই পরিবর্তন করতে হলে যুবসমাজকে বই পড়াতে হবে। বই পড়লেই কেবল এই দেশ সামনের দিকে এগোতে পারবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মনির উদ্দিন সিকদার বলেন, জ্ঞান লালন এবং ধারণ করার মাধ্যম হলো বই। একটা বিশ্ববিদ্যালয় কতটা জ্ঞান ধারণ করবে এবং লালন করবে, তা নির্ভর করে বইয়ের ওপর। জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বইয়ের যে অবদান, বর্তমান প্রজন্ম সে জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে। তারা চ্যাটজিপিটি বা ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফর্মমুখী হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জ্ঞানের মাধ্যম হিসেবে বইয়ের বিকল্প নেই। সবাইকে বইমুখী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার সভাপতি হামিদা জান্নাত। এ সময় বন্ধুসভার বন্ধুরা ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে মেলাপ্রাঙ্গণ ঘুরে দেখেন আমন্ত্রিত অতিথিরা।

আয়োজকেরা জানান, আগামী শুক্রবার পর্যন্ত ছুটির দিনসহ প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত মেলা চলবে। মেলা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। মেলায় প্রথমা প্রকাশনের বইয়ে ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় পাওয়া যাবে। পাশাপাশি ভারতীয় বই ১ রুপি সমান দেড় টাকা থেকে ১ টাকা ৮০ পয়সা হারে বিক্রি হবে।