‘বই উপহারের চর্চা করতে হবে’

বইমেলায় বই দেখছেন পাঠকেরা
ছবি: বন্ধুসভা
‘আমরা আগে টেক্সট বইয়ের নিচে লুকিয়ে রেখে গল্পের বই পড়তাম। আজকের ছেলেমেয়েদের অনুরোধ করেও পড়ানো যায় না। প্রযুক্তি আমাদের অনেক এগিয়ে নিলেও বই না পড়লে সত্যিকার অর্থে খুব একটা আগানো যায় না।’

‘আজকের তরুণ প্রজন্ম মোবাইলে আসক্তির কারণে শারীরিক ও মানসিকভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অনেক পরিবার এ সমস্যার ভুক্তভোগী। আগে আমরা বন্ধুরা বই ধার করে একে অপরেরটা পড়তাম। বইয়ের মধ্যে সুখ, দুঃখ, আনন্দসহ নানা অনুভূতি আছে। কেউ যদি সেই মজা পেয়ে যায়, তাহলে সে এমনিতেই বইমুখী হবে।’—বলছিলেন ফরিদপুরের সরকারি সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ কাজী গোলাম মোস্তফা।

১২ জুন ফরিদপুর প্রেসক্লাব মিলনায়তনে শুরু হয়েছে প্রথমা প্রকাশনার ছয় দিনব্যাপী বইমেলা, চলবে ১৭ জুন পর্যন্ত। মেলা প্রতিদিন বেলা ১১টায় শুরু হয়ে শেষ হচ্ছে রাত সাড়ে ৮টায়। প্রথমাসহ বিভিন্ন প্রকাশনীর বই সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ ছাড়ে বিক্রি করা হচ্ছে। সার্বিক সহযোগিতা করছে ফরিদপুর বন্ধুসভা। ১২ জুন মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাচ্চাদের আমরা পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্য বই কিনে দিতে আগ্রহী না। আজকালকার বাচ্চারা জানেই না যে পাঠ্যবই ছাড়া বই আছে। বই লেখা হয় পাঠকের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য। সেটা নিবারণ করতে পারলে পাঠক সেই বই পড়বে।’

মেলায় বয়স্ক পাঠকেরাও আসেন
ছবি: বন্ধুসভা

ফরিদপুর মহিলা পরিষদের সভাপতি শিপ্রা রায় বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তরুণেরা মোবাইলের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। বর্তমান প্রজন্মের বইবিমুখ হওয়ার পেছনে এটাই দায়ী। আমাদের মায়েরা যদি বইমুখী হই, তাহলে বাচ্চারাও বই দেখে দেখে বড় হবে, বইয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মাবে, বই পড়া শিখবে।’

ফরিদপুর ফুলকির সভাপতি অশীতিপর অঞ্জলি বালা বলেন, ‘আমরা বয়স্করা অনেক বই পড়েছি। এখন বাচ্চাদের বই পড়াতে হবে। জন্মদিনসহ বিভিন্ন সামাজিক আয়োজনে বই উপহারের চর্চা করতে হবে। আজকাল দেখা যায়, জিপিএ-৫ পাওয়া অনেক ছেলেমেয়েরাও ভালোভাবে কথা বলতেও পারে না। তাদের ভেতরে জ্ঞানের অভাব, কী বলবে মাথায় থাকে না। বই না পড়লে ভাষা আয়ত্ত করা যায় না। বই পড়ার চর্চা থাকতে হবে।’

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান
ছবি: বন্ধুসভা

ফরিদপুর মুসলিম মিশনের সাধারণ সম্পাদক এম এ সামাদ বলেন, ‘বই কেনা দরকার, বই পড়া দরকার। অভিভাবক-শিক্ষকেরা গুরুত্ব দিলেই ছেলেমেয়েরা বইমুখী হবে। আজকাল শিক্ষকেরাই বই পড়েন না, ছাত্ররা কেন পড়বে?’ ফরিদপুর সচেতন নাগরিক কমিটির সাবেক সভাপতি আলতাফ হোসেন বলেন, ‘আজকের মেলায় এসে চমৎকার চমৎকার বই দেখলাম। এ মেলার কথাটি আপনাদের সহকর্মীদের বলবেন, শিক্ষার্থীদের বলবেন, যেন তাঁরা সবাই অন্তত একটি করে হলেও বই কেনেন।’

সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ অসীম কুমার সাহা বলেন, ‘বর্তমানে তরুণ-যুবক, বৃদ্ধ—সবাই মোবাইলে ডুবে গেছে। সেখান থেকে আমাদের বের হতে হবে। বড়দের বই পড়তে হবে। বড়রা পড়লে বাচ্চারাও তা দেখে বই পড়তে উদ্যোগী হবে।’ ইয়াছিন কলেজের অধ্যক্ষ ফজলুল হক খান বলেন, ‘বুক এখন বাদ। বুক এখন একটাই, সেটা হলো ফেসবুক। আমাদের ফেসবুক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বই অনন্ত যৌবনা।’

বইমেলায় বই দেখছেন পাঠকেরা
ছবি: বন্ধুসভা

ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) সুমন রঞ্জন সরকার বলেন, ‘আমাদের অনেক তরুণ প্রজন্মও বই পড়ে। তবে অনেকে অনলাইনে জুয়া খেলে টাকা খরচ করে। ওই টাকা দিয়ে কেনার কথা ছিল বই। ফেসবুকের দাপটটা খুব দ্রুত পড়ে যাবে। তখন আমাদের বইয়ের জোগান লাগবে। সে জন্য আমাদের বই রেডি রাখতে হবে।’ প্রবীণ নাগরিক মফিজ ইমাম মিলন বলেন, ‘বই পড়ার আন্দোলন প্রথমা গর্বের সঙ্গে, সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শহরের শেরেবাংলা পাঠাগার বিলুপ্তির পথে, সুফি পাঠাগার ধুঁকে ধুঁকে চলছে। আমাদের বই পড়ার অভ্যাস বাড়াতে হবে।’

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এফডিএর নির্বাহী পরিচালক আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘এ প্রজন্মের বই পড়ার আগ্রহ নেই। তবু আমাদের আশা রাখতে হবে। নতুন প্রজন্মকে বই পড়ার জন্য বলতে হবে, আগ্রহী করাতে হবে।’ ফরিদপুরের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রাসিনের পরিচালক আসমা আক্তার মুক্তা বলেন, ‘আমরা আগে টেক্সট বইয়ের নিচে লুকিয়ে রেখে গল্পের বই পড়তাম। আজকের ছেলেমেয়েদের অনুরোধ করেও পড়ানো যায় না। প্রযুক্তি আমাদের অনেক এগিয়ে নিলেও বই না পড়লে সত্যিকার অর্থে খুব একটা আগানো যায় না।’

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক প্রবীর কান্তি বালা। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ফরিদপুর বন্ধুসভার বন্ধু মানিক কুণ্ডু, জাহিদুজ্জামান খান, সুমিত বসু, বাধন পাল, লক্ষ্মণ চন্দ্র মণ্ডল, সুব্রত পাল, তাওহিদুজ্জামান খান প্রমুখ।

সাধারণ সম্পাদক, ফরিদপুর বন্ধুসভা