বাংলা ছোটগল্পের অন্যতম অনবদ্য সৃষ্টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হৈমন্তী’। সমাজের কঠোর বাস্তবতা, রক্ষণশীলতার শৃঙ্খল এবং নারীর প্রতি অবিচারের মর্মস্পর্শী চিত্র ফুটে উঠেছে এই গল্পে। ২০ মার্চ মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি বন্ধুসভা অনলাইনে আয়োজন করে এক বিশেষ পাঠচক্র। যেখানে ‘হৈমন্তী’ গল্পের নান্দনিক বিশ্লেষণ ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন বন্ধুরা।
পাঠাগার ও পাঠচক্র সম্পাদক সুস্মিতা চৌধুরীর সঞ্চালনায় পাঠচক্রের আলোচনায় উঠে আসে, গল্পের দার্শনিক ও সামাজিক দিক। সুস্মিতা চৌধুরী বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ এই গল্পের মাধ্যমে নারীর সামাজিক অবস্থান, যৌতুক প্রথা এবং পরিবারের সংকীর্ণ মানসিকতার করুণ পরিণতি অত্যন্ত সূক্ষ্ম শৈল্পিকতায় ফুটিয়ে তুলেছেন।’
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হৈমন্তী এক শিক্ষিতা, স্বাধীনচেতা ও সত্যনিষ্ঠ নারী; যে পণের নিষ্ঠুর শিকারে পরিণত হয়। তার স্বামী অপু, যে প্রথমে তাকে ‘শিশির’ নামে সম্বোধন করে—এক কোমল, স্বচ্ছ ও পবিত্র সত্তার প্রতিচ্ছবি। অপু তাকে ভালোবাসলেও, সমাজের শৃঙ্খল ভাঙতে ব্যর্থ হয়। শ্বশুরবাড়ির অবহেলা ও অন্যায়ের শিকার হয়ে হৈমন্তী নিঃসঙ্গ ও অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু কেউ তার প্রতি সহানুভূতি দেখায় না। গল্পের শেষে অপু জানতে পারে, তার মা নতুন পাত্রী খুঁজছে—এটাই সমাজের নির্মম বাস্তবতা। সমাজ বদলায় না, শুধু হৈমন্তীর মতো হাজারো মেয়ের জীবন করুণ পরিণতির শিকার হয়।
সভাপতি ঝর্ণা দাশ বলেন, ‘হৈমন্তী কেবল একটি ট্র্যাজেডির গল্প নয়, এটি এক যুগের প্রতিবিম্ব। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শব্দের নিখুঁত প্রয়োগে সমাজের পিতৃতান্ত্রিক নির্মমতার প্রতিচিত্র এঁকেছেন। যৌতুক প্রথার অভিশাপ, নারীর প্রতি পরিবার ও সমাজের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং এক শিক্ষিতা, সত্যনিষ্ঠ নারীর অন্তঃসারশূন্য জীবনের করুণ পরিণতি গল্পটিকে দিয়েছে এক অনন্য মাত্রা।’
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তারেক মিয়া বলেন, ‘হৈমন্তী শুধু একজন নারীর প্রতিচ্ছবি নয়, এটি এক নিঃশব্দ প্রতিবাদ। তার কোমল, স্বচ্ছ, পবিত্র সত্তা সমাজের কঠোর নিয়মের বিপরীতে এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা, যা নিভে যায় নিষ্ঠুর বাস্তবতার আঘাতে। রবীন্দ্রনাথ যেন প্রশ্ন রেখেছেন—কবে বদলাবে এই সমাজ? কবে নারীরা নিজেদের প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা ফিরে পাবে?’
যুগের পর যুগ ‘হৈমন্তী’ গল্পটি প্রাসঙ্গিক থেকেছে। কারণ, সমাজের ভিত এখনো বদলায়নি। আজও হাজারো হৈমন্তী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, পণের জন্য প্রাণ হারাচ্ছে কিংবা হারিয়ে যাচ্ছে সমাজের নিয়মের অন্ধকার গহ্বরে।