সহমর্মিতার ঈদ
বন্ধুদের ভালোবাসায় দেশজুড়ে রঙিন ঈদ
নিজেদের ঈদের কেনাকাটার বাঁচানো অর্থ এবং উপদেষ্টা, শুভাকাঙ্ক্ষী ও পরিচিতদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অনুদানে দেশ ও দেশের বাইরের ৮৩টি বন্ধুসভা স্বেচ্ছাসেবায় ‘সহমর্মিতার ঈদ’ বাস্তবায়ন করেছে। কর্মসূচিতে শিশুর জন্য নতুন জামা, মেহেদি উৎসব এবং তাদের পরিবারের জন্য খাদ্যসামগ্রী, বিশেষ চাহিদায় কাউকে কাউকে চিকিৎসাসহায়তা দেওয়া হয়েছে।
‘ছয় মাস আগে অসুখ হয়া হামার মা মরি গেইচে। এখন হামাক দেখার কাইয়ো নাই। মোর বাপ অসুখে কাম করবের যায় না। নতুন জামা কোনা পায়া ভালো লাগচে। ঈদোত গাউত দিব্যার পামো।’ গাইবান্ধা বন্ধুসভার কাছ থেকে নতুন জামা পেয়ে এভাবেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের গোঘাট গ্রামের আট বছরের শিশু রুবি আক্তার।
ঈদের আগে নতুন পোশাক পেয়ে ভীষণ খুশি কেরানীগঞ্জের ১২ বছরের শিশু সামিয়া আক্তার। তার সহজ কথা, ‘নতুন জামাটা আমার খুব পছন্দ হইছে। এটা পরে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাব।’ নতুন জামা দিয়ে কী করবে, জানতে চাইলে খুলনা নিউমার্কেট এলাকার আন নূর নূরানী স্কুলের চার বছর বয়সী আশা মুচকি হাসি দিয়ে বলে, ‘ঈদের দিন গায় দ্যাবো।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার বিদিরপুর রেললাইনের পাশে খাসজমির বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ্ব কৃষিশ্রমিক মো. হাবিল সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন চার বছর বয়সী নাতনি রহিমা ও আট বছর বয়সী নাতি ইব্রাহীমকে। বন্ধুসভার নতুন পোশাক পেয়ে তাদের হাসি দেখে ঈদের খুশি মো. হাবিলের মনে। তিনি বলেন, ‘অরঘে বাপ বহুদিন আগেই ছাইড়্যা চইল্যা গেছে। কুনুরকমে টাইন্যাটুইন্যা দিন আনি দিন খাই। তোমারঘে জামা দুইট্যা পাইয়া খুব খুশি হইয়াছি। তোমারঘে লাইগ্যা দোয়া করব।’
দেশজুড়ে সামিয়া, রুবি, রহিমা, আশা, ইব্রাহীম আর হাবিলদের মতো হাজারো শিশু ও তাদের পরিবারের জন্য এবারের ঈদ আনন্দময় করে তুলেছেন বন্ধুসভার বন্ধুরা। জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের আহ্বানে ‘সহমর্মিতার ঈদ’ কর্মসূচির আওতায় প্রতিবারের মতো এবার রোজার ঈদেও দেশ ও দেশের বাইরের বন্ধুসভার বন্ধুরা ৪ হাজার ৩৩১ শিশুকে নতুন পোশাক ও এই শিশুদের পরিবারসহ মোট ৪ হাজার ৫০২ পরিবারকে ঈদের খাদ্যসামগ্রী উপহার দিয়েছেন। নিজেদের ঈদের পোশাক কেনার টাকা থেকে কিছুটা বাঁচিয়ে, শুভাকাঙ্ক্ষী ও পরিচিতজনদের সহায়তায় বন্ধুরা মোট ৩৪ লাখ ৮৫ হাজার ৩৫৫ টাকার পোশাক ও খাদ্যসামগ্রী উপহার দেন। সারা দেশের ৮৩টি বন্ধুসভা এই কর্মসূচি পালন করেছে।
বন্ধুসভার বন্ধুরা মিলে আমরা মানবিক কাজ করি। আলোকিত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য অনেক কাজ করি। সব কটি কাজ গুরুত্বপূর্ণ, তবে সহমর্মিতার ঈদকে অনিন্দ্যসুন্দর একটা কাজ বলে মনে হয়। এখানে বন্ধুরা নিজেদের উদ্যোগে অন্যদের সহযোগিতা করে। যখন আমরা একজনের মুখেও হাসি দেখি, তখন স্বর্গীয় সুখ অনুভব করি। এমন কার্যক্রম অন্য সংগঠনগুলোও হাতে নিলে আমাদের বাংলাদেশ আরও সুন্দর হবে।
চট্টগ্রাম বন্ধুসভা তিন ধাপে প্রায় ৪০০ শিশু ও তাদের পরিবারের মধ্যে নতুন পোশাক ও খাদ্যসামগ্রী উপহার দিয়েছে। নতুন জামা পরে আনন্দে মেতেছিল শিশুরা এবং খাদ্যসামগ্রী পেয়ে খুশির ঝিলিক ছিল তাদের পরিবারের সদস্যদের চোখেমুখে। নোয়াখালী বন্ধুসভাও চার ধাপে ১২০ শিশু ও তাদের পরিবারকে নতুন পোশাক ও খাদ্যসামগ্রী উপহার দেয়।
কক্সবাজার পৌরসভার সমুদ্র উপকূলীয় কুতুবদিয়াপাড়ায় জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারের ৫৪ শিশুর হাতে ঈদের নতুন পোশাক তুলে দেয় কক্সবাজার বন্ধুসভা। এর সঙ্গে কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া, ফদনারডেইল, মোস্তাইক্যাপাড়ার হতদরিদ্র আরও ১৯০ পরিবারে ঈদের খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেন বন্ধুরা।
ময়মনসিংহ বন্ধুসভার কানাডাপ্রবাসী বন্ধু তোফাজ্জল হোসেন ২৯৫ পরিবারকে সহায়তার দায়িত্ব নেন। অন্য বন্ধু, উপদেষ্টা ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহায়তায় এবার ময়মনসিংহ বন্ধুসভার উদ্যোগে মোট ৫৩২ পরিবারে ঈদ উপহার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। গোয়ালন্দ বন্ধুসভা ১৯০ পরিবারকে ঈদ উপহার দেওয়ার পাশাপাশি অসুস্থ আবেদ আলীকে অর্থসহায়তা দিয়েছে। গোয়ালন্দ উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের নতুনপাড়ার বাসিন্দা তিনি। কয়েক বছর ধরে ফুসফুস ছিদ্র হওয়াসহ শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। চিকিৎসার ব্যয় চালাতে নিজের সামান্যটুকু জমি ও ভিটাবাড়ি বিক্রি করেছেন তিনি।
জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের উদ্যোগে ঢাকার কালশী ও মোহাম্মদপুর এলাকায় ২৩০ শিশুকে নতুন পোশাক ও ২২৫ পরিবারকে খাদ্যসামগ্রী উপহার দেওয়া হয়েছে। মহানগর বন্ধুসভাও সাভারের একটি বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের নতুন পোশাক ও খাদ্যসামগ্রী উপহার দেয়।
সহমর্মিতার ঈদ কর্মসূচি দেশজুড়ে বন্ধুদের সহমর্মিতা ও মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বন্ধুসভার অনেক কাজের মধ্যে এই কাজ সারা দেশে ব্যাপক আনন্দ ও উৎসাহ নিয়ে উদ্যাপন করি আমরা। সম্পূর্ণ নিজেদের উদ্যোগে শত শত শিশু ও তাদের পরিবারে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়া অসাধারণ একটি বিষয়। এমন কাজের মধ্য দিয়ে বন্ধুরা নিজেদের খুঁজে পান, সমাজে ভালোবাসা ও সহমর্মিতার বার্তা ছড়িয়ে দেন।
‘সহমর্মিতার ঈদ’ কর্মসূচির আওতায় নতুন পোশাক ও খাদ্যসামগ্রী উপহারের পাশাপাশি অনেক বন্ধুসভা ঈদের আগে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের হাত মেহেদির রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। তাদের নিয়ে মেহেদি উৎসব করেছে। অনেকে আবার অসুস্থ ও অক্ষম ব্যক্তিকে অর্থ, চিকিৎসা কিংবা ওষুধ দিয়ে ঈদের আগেই কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে।
এ বছর এই কর্মসূচি সমন্বয় করেছেন জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের দুর্যোগ ও ত্রাণ সম্পাদক সায়মন চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে বিভাগীয় সমন্বয়ক হিসেবে যুক্ত ছিলেন রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী, শাহিদা আলম, সাইমুম মৌসুমী বৃষ্টি, খায়রুন নাহার খেয়া, আলাদিন আল আসাদ, সৌমেন্দ্র গোস্বামী, আসিফ খান, নাঈমা সুলতানা, অনিক সরকার, মীর মোশারেফ, তৌহিদুল ইসলামসহ অন্য বন্ধু।
যেসব বন্ধুসভা সহমর্মিতার ঈদ বাস্তবায়ন করেছে
জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ, ঢাকা মহানগর, কাতার, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, খুলনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাইবান্ধা, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, ইষ্টার্ন ইউনিভার্সিটি, নাটোর, বরগুনা, কক্সবাজার, কুড়িগ্রাম, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, লালমনিরহাট, গোপালগঞ্জ, দিনাজপুর, সৈয়দপুর, জয়পুরহাট, সিলেট, ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, পটিয়া, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, মুরারিচাঁদ কলেজ, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চকরিয়া, ঝিনাইদহ, মিরপুর, নোয়াখালী, রায়গঞ্জ, বরিশাল, রাঙামাটি, ময়মনসিংহ, জামালপুর, ফরিদপুর, নরসিংদী, মোংলা, ভৈরব, রাঙ্গুনিয়া, ভোলা, পঞ্চগড়, কিশোরগঞ্জ, পুণ্ড্র ইউনিভার্সিটি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নড়াইল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা, গাজীপুর, রংপুর, রাউজান, কেরানীগঞ্জ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সরিষাবাড়ী, সুনামগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সাভার, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, চাঁদপুর, ফেনী, গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী, বাগেরহাট, কেশবপুর, পাবনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, শেরপুর, লক্ষ্মীপুর, নওগাঁ, বগুড়া, চট্টগ্রাম ও মাদারীপুর।