‘প্রথম আলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহস নিয়ে সত্যকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা সব সময় নিপীড়নের পাশে দাঁড়িয়েছে। কবি রফিক আজাদ বলেছিলেন, “ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো।” সেটির বিরুদ্ধে তো সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। প্রথম আলোর একজন সাংবাদিক ক্ষুধা নিয়ে একটি রিপোর্ট করেছে। সেটি নিয়ে কেন পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে নাড়তে হবে? আজকে চারদিকে যখন ক্ষুধার হাহাকার চলছে, চাই আমার ক্ষুধার মুক্তি ও স্বাধীনতা। এ রকম একটি সময়ে একজন সাংবাদিক সংবাদ করেছে। আর রাষ্ট্র তার পুরো শক্তি দিয়ে গভীর রাতে তাকে তুলে নিয়েছে, যা চরম অন্যায়।’ রাজশাহী বন্ধুসভা আয়োজিত মানববন্ধনে এসব কথা বলেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান।
১ এপ্রিল বিকেলে রাজশাহী নগরের সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে প্রথম আলোর সাভারের নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানের মুক্তি, সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন পালিত হয়েছে। এ কর্মসূচিতে রাজশাহীর ৯টি সংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা একাত্মতা প্রকাশ করে বক্তব্য দেন। তাঁরা সবাই সাংবাদিক শামসুজ্জামানের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলেরও দাবি জানান।
রাজশাহী বন্ধুসভার সহসভাপতি জাহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য দেন সভাপতি সাব্বির খান। এতে আরও বক্তব্য দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম, রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান, হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি ও গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সদস্য মাহমুদ জামান কাদেরী, রাজশাহী পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক মাহবুব টুংকু, সদস্যসচিব নাজমুল হোসেন রাজু, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) রাজশাহীর কোষাধ্যক্ষ কে এম জোবায়ের, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাবের সভাপতি কামরুল হাসান অভি, রাজশাহী সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুস সবুর লোটাস প্রমুখ।
মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী ইতিহাস পরিষদের সদস্যসচিব শফিকুল ইসলাম, রাজশাহী মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুর রহমান। আরও উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আবুল কালাম আজাদ, প্রতিনিধি শফিকুল ইসলাম, রাজশাহী বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান, সাংঠনিক সম্পাদক পরওয়ার হোসেনসহ অন্য বন্ধুরা এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীরা।
রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, ‘পবিত্র রমজান মাসে রাতের অন্ধকারে শামসুজ্জামানকে সাদাপোশাকধারী পুলিশ নিয়ে গেছে। তাঁর মা বারবার আপত্তি করে বলেছেন, “আমার সন্তানকে কেন আপনারা তুলে নিয়ে যাচ্ছেন।” এ রমজান মাসে মানুষের এবাদত কবুল হয়। এখন শামসুজ্জামানের মা চোখের পানি ফেলে চিৎকার করছেন ছেলের জন্য। কী অপরাধ শামসের? কী অন্যায় তাঁর মায়ের? এ রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন। অবিলম্বে শামসকে মুক্তি দিতে হবে। প্রথম আলোর মতিউর রহমান এ দেশের মানুষের মৌলিক অধিকারের কথা বলেন। আর সেটাই হয়ে যায় এ দেশে অপরাধ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। এ দেশের সব মানুষ বলে আসছে, এই আইন মানুষকে শুধু কষ্টই দেবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি দেশের ভালো চান। কিন্তু দেশের মানুষ যে এ আইন চায় না, সেটা অবশ্যই আপনাকে বিবেচনা করতে হবে।’
অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম বলেন, ‘যে প্রতিবেদনের কথা বলা হচ্ছে, সেটি অনেকের দৃষ্টিতে ভুল হতে পারে, অনেকেই তা মনে করতে পারেন। কিন্তু এটা সর্বজনীন ভুল নয়। সেই প্রতিবেদন আমি পড়েছি। সেখানে কোনো অসংগতি আমার কাছে মনে হয়নি। বরং একজন খেটে খাওয়া মানুষের মনের কষ্ট সেখানে আনা হয়েছে। কিন্তু রাতের আঁধারে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ খবরে সারা দেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হওয়ায় বাধ্য হয়ে তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়েছে। মামলাটিও পরে করা হয়। এখানে অত্যন্ত আইনের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। এই ডিজিটাল আইনের মাধ্যমে প্রথম আলোর সম্পাদককে হয়রানি করা হচ্ছে। এ মামলা প্রত্যাহারসহ আইনটি বাতি করতে হবে। মানুষকে কথা বলতে দিতে হবে।’
গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘একের পর এক সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে। এ দেশের সচেতন মানুষ সবাই খুবই মর্মাহত। শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকের সম্পাদক ও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা মেনে নেওয়া যায় না। এ আইন দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে কালো আইন হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধানও এ আইন বাতিলের দাবি জানাচ্ছেন। এ দেশেও সচেতন নাগরিকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বারবার। আমাদের এ অনুভূতিকে সম্মান জানান।’
রাজশাহী পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক মাহবুব টুংকু বলেন, ‘সাংবাদিকের ভুল হলে বাংলাদেশে প্রেস কাউন্সিল আছে, যেখানে সংক্ষুব্ধ হলে যে কেউ যেতে পারেন। কিন্তু সরকার একটি আইন করেছে, যে আইনকে বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ বলছেন, এটা একটি নিবর্তনমূলক আইন। সেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে কারাবন্দী করে রাখা হয়েছে। এ সরকারের অনেকেই বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে। তাঁরা বলেছেন, এ আইন কোনো সাংবাদিকের ওপর প্রয়োগ করা হবে না। কোনো সাধারণ মানুষের ওপর করা হবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, হরহামেশাই এ আইন সাংবাদিকদের ওপর নেমে আসছে, তাঁর কলমের দিকে নেমে আসছে।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদ জামান কাদেরী বলেন, বিভিন্নভাবে বলা হচ্ছে, এ সংবাদ নাকি দেশের স্বাধীনতার ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছে। ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা এত দুর্বল হলো কী করে। যাঁরা এমন চিন্তা করেন, তাঁদের চিন্তার মধ্যে ভুল আছে, উদ্দেশ্য আছে, এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। পাকিস্তান আমলেও এ ধরনের আইনের বিরুদ্ধে কথা হয়েছে। দেশ স্বাধীনের পরও যে এ ধরনের বিষয়ে কথা বলতে হবে, তা ভাবেননি। যে স্বাধীনতার জন্য তাঁরা লড়াই করেছেন, আন্দোলন করেছেন, সেখানে তাঁর মধ্যে বাক্স্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা ছিল অন্যতম। এ স্বাধীনতাকে সংকুচিত না করার আহ্বান করেছেন তিনি।
সভাপতি, রাজশাহী বন্ধুসভা