রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘অপরিচিতা’ প্রথম প্রকাশিত হয় প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত মাসিক ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার ১৩২১ বঙ্গাব্দের (১৯১৪) কার্তিক সংখ্যায়। এটি প্রথম গ্রন্থভুক্ত হয় রবীন্দ্রগল্পের সংকলন ‘গল্পসপ্তক’-এ এবং পরে, ‘গল্পগুচ্ছ’ তৃতীয় খণ্ডে (১৯২৭)। গল্পটি উত্তম পুরুষে লেখা। যৌতুকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ।
‘অপরিচিতা’ গল্পটি নারীর মর্যাদাপ্রতিষ্ঠার কথা বলে। মর্যাদাপ্রতিষ্ঠায় নারীর যে বিদ্রোহ, গল্পে লেখক তারই পটে নারীর দৈহিক নয়, মানসিক সৌন্দর্য দেখিয়েছেন। নায়িকা কল্যাণীর বিদ্রোহ-প্রয়াসে অংশীদার তার পিতা শম্ভুনাথ সেন। কল্যাণী স্বাধীনচেতা ও ব্যক্তিত্বময়ী এক চরিত্র। কাপুরুষ ও সিদ্ধান্ত নিতে অপরাগ অনুপমকে বিয়ে না করে আজীবন দেশমাতৃকার সেবা করার শপথ নেয়। গল্পের তাকে আমরা দেখতে পাই প্রতিবাদী রূপে।
শম্ভুনাথের কন্যা কল্যাণীর বিয়ে ঠিক হয়েছে কলকাতার এক এমএ পাস যুবক অনুপমের সঙ্গে। পিতার মৃত্যুর পর অনুপম মায়ের কাছেই মানুষ হয়। পারিবারিক কোনো বিষয়ে তাকে মাথা ঘামাতে হয়নি। অনুপম ছিল মায়ের অনুগত সন্তান। এ গল্পে সে নিজেকে একজন ভালো মানুষ ও সৎ পাত্র হিসেবে দাবি করে। বরের অভিভাবক তার মামা। নিয়মানুসারে বিয়ের কাজ ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হতে থাকে। অন্যদিকে অনুপমের মামা বিয়ের পণের ব্যাপারে কোনো প্রকার ছাড় দিতে রাজি নন। এখানেই গল্পের কাহিনি জটিলতায় রূপ নেয়। পণের টাকা এবং দরদস্তুরি আগেই ঠিক ছিল। শম্ভুনাথ লোকটির ব্যবহার ঠান্ডা। পাত্রীপক্ষের সঙ্গে নির্লজ্জ দরাদরি, স্বর্ণালংকার সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ, নিজের সেকরাকে দিয়ে সেই অলংকার পরীক্ষা করানোয় যে ইতরতা প্রকাশ পেয়েছে, মেরুদণ্ডহীন নায়ক তাতে সায় দিয়েছে। ফলে কন্যার পিতা বিয়ে ভেঙে দিয়েছেন। আর কল্যাণীও তাতে সায় দেয়।
‘অপরিচিতা’ বাগদত্তার প্রতি মনস্তাপে ভেঙে পড়া এক ব্যক্তিত্বহীন যুবকের প্রেমানুভূতির গল্প আর অনুশোচনাবোধের অকপট কথামালা। এই গল্পে অপরিচিতা বিশেষণের আড়ালে রয়েছে এক বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী নারী, যে সমাজে জেঁকে বসা ঘৃণ্য যৌতুকপ্রথার বিরোধিতা করেছে।
১০ জানুয়ারি ‘অপরিচিতা’ গল্পটি নিয়ে পাঠচক্র করেছে সিলেট বন্ধুসভা। প্রথম আলোর সিলেট অফিসের বন্ধুসভা কক্ষে এটি অনুষ্ঠিত হয়। পাঠচক্রে বইটির প্রকাশকাল ও বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করেন বন্ধু ফয়সাল আহমদ। তিনি বলেন, এ গল্পে পিতা শম্ভুনাথ সেন এবং কন্যা কল্যাণীর স্বতন্ত্র দীক্ষা ও আচরণে সমাজে গেড়ে বসা ঘৃণ্য যৌতুকপ্রথা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। পিতার বলিষ্ঠ প্রতিরোধ এবং কন্যা কল্যাণীর দেশচেতনায় ঋদ্ধ ব্যক্তিতের জাগরণ ও তার অভিব্যক্তিতে গল্পটি সার্থক।
বন্ধু আফসানা চৌধুরী বলেন, ‘গল্পের অনুপম শিক্ষিত, মার্জিত। কিন্তু স্পষ্ট কথা বলার মতো সাহস তার নেই। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে না, যা তার মেরুদণ্ডহীন সত্তাকে তুলে ধরে।’ এ ছাড়া বইটি নিয়ে আলোচনা করেন বন্ধু শতাব্দী দত্ত, জয়শ্রী রানী মোহন্ত, কিশোর দাশ ও অনিক সেন।
পাঠের আসরে আরও উপস্থিত ছিলেন বন্ধু দেব রায় সৌমেন, ফারহানা হক, সুবর্ণা দেব, ফারহা হক, এসিতা রানী নাথ, শাহরিয়ার হক, শ্রেয়ান ঘোষ, নাহিয়ান রাহমান, জয় তালুকদার, প্রণব চৌধুরী, জুনায়েদ আহমেদ, রেজাউল হকসহ অন্য বন্ধুরা।
পাঠাগার ও পাঠচক্র সম্পাদক, সিলেট বন্ধুসভা