‘মায়ের অভাব পূরণ করে মেয়েরা’

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ‘কথা হোক: বাবা-মেয়ের গল্প শুনি’ অনুষ্ঠানছবি: প্রথম আলো

‘মেয়েরা মায়ের জাত। মায়ের অভাব পূরণ করে মেয়েরা। মেয়েরা কোনো দিন বিরক্ত করেনি। তাদের কোনো আবদারও অপূর্ণ রাখিনি। মেয়েরা শেষ দিন পর্যন্ত বাবাকে আদর–যত্নে রাখে।’ ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ‘কথা হোক: বাবা-মেয়ের গল্প শুনি’ অনুষ্ঠানে এসে এ কথা বলেন এ কে এম আবদুল হাই।

প্রথম আলোর আমন্ত্রণে ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া নার্সিং ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে অতিথি হিসেবে আসেন বাবা এ কে এম আবদুল হাই এবং তাঁর দুই মেয়ে লুৎফা হাই ও শায়লা হাই। লুৎফা হাই পেশায় ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের গাইনি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। শায়লা হাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জজ আদালতের আইনজীবী। আবদুল হাইয়ের বড় মেয়ে হাফসা হাই খাদ্য অধিদপ্তরে কর্মরত এবং একমাত্র ছেলে সাইফুল হাই চিকিৎসক।

আবদুল হাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জজ আদালতের অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি ও সদর উপজেলা সাদেকপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। প্রথম আলো ডটকমের সহযোগিতায় জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) সেলিব্রেটিং ডটার্স ক্যাম্পেইনের আওতায় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শুরুতেই অতিথিদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান বন্ধুসভার বন্ধু মাইনুদ্দীন রুবেল, অনন্যা সাহা, ফাহমিদা জেনি, ফোজিয়া হক, সবুজ মোল্লা ও ইসরাত খুশি। গল্পে গল্পে বাবা ও দুই মেয়ে নিজেদের সম্পর্কের নানা দিক তুলে ধরেন।

লুৎফা ও শায়লা দুজনই বলেন, ‘বাবাকে কখনো কোনো দিন একটি কথা বলা হয়নি। আজ বলতে চাই, আব্বু আমরা তোমাকে অনেক ভালোবাসি ‘

বাবার সঙ্গে সম্পর্ক কেমন, এমন প্রশ্নের জবাবে ছোট মেয়ে শায়লা বলেন, ‘বাবার সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করি। আমাদের সম্পর্ক অনেক ভালো। কাজের বাইরে বাবা বাইরে কোথাও আড্ডা দেন না। ওনার প্রতি আমাদের কোনো অভিযোগ নেই।’ লুৎফা বলেন, ‘বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্কও ভালো। বাবা ব্যস্ত থাকেন। ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের সময় দেন। তবে যতটুকু সময় পান, আমাদের সঙ্গে গল্প করেন। বাবার কোনো বিষয়ে অভিযোগ বা অভিমানের প্রশ্নই ওঠে না। বাবা সেই সুযোগটি কোনো দিন দেননি।’

বাবার কাছে যদি চিঠি লেখা হয়, তবে সেখানে কী থাকবে? লুৎফা জানান, বাবাই তাঁর সব। চাওয়ার আগে সব আবদার পূরণ করেছেন বাবা। বাবা তুমি আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। আর শায়লার চিঠিতে থাকবে বাবার জন্য কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদবার্তা। তাঁর বেড়ে ওঠার সবকিছুর সঙ্গে রয়েছে বাবার সম্পৃক্ততা। বাবা, ‍তুমি পৃথিবীর সেরা ও শ্রেষ্ঠ বাবা। বাবা তোমার অবদান শোধ হওয়ার নই।

লুৎফা ও শায়লা দুজনই বলেন, ‘বাবাকে কখনো কোনো দিন একটি কথা বলা হয়নি। আজ বলতে চাই, আব্বু আমরা তোমাকে অনেক ভালোবাসি। কারণ, এটিই প্রথম কোনো অনুষ্ঠান, যেখানে আমরা বাবা-মেয়েরা অতিথি।’

বাবা ও তাঁর দুই মেয়েকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান বন্ধুসভার বন্ধু মাইনুদ্দীন রুবেল, অনন্যা সাহা, ফাহমিদা জেনি, ফোজিয়া হক, সবুজ মোল্লা ও ইসরাত খুশি
ছবি: প্রথম আলো

আবদুল হাই বলেন, ‘আমার তিন মেয়ে ও মা। অর্থাৎ আমার চার মা। মা আমাকে যেভাবে আদর করেছেন, স্নেহ দিয়েছেন, আমিও মেয়েদের সেভাবে আদর ও স্নেহ করি। যে বছর মায়ের মৃত্যু হয়েছে, সে বছর ছোট মেয়ে শায়লার জন্ম হয়েছে। মায়ের অভাব তিন মেয়ে পূরণ করেছে। এক ছেলে সাইফুল হাই চিকিৎসক, বড় মেয়ে হাফসা হাই খাদ্য বিভাগে কর্মরত। সবাই জনসেবামূলক পেশায় সম্পৃক্ত। ছেলের অবদার কোনো দিন প্রথমবার পূরণ করিনি। কিন্তু মেয়েদের কোনোটাই অপূর্ণ রাখিনি। মেয়েরা মায়ের জাত। মেয়েদের জায়গা কেউ দখল করতে পারবে না। মেয়েরা বাবাকে শেষ দিন পর্যন্ত আদর-যত্নে রাখে। আর ছেলেরা বিয়ের পর স্ত্রী নিয়ে অন্যত্র চলে যান। ছেলের তুলনায় মেয়েদের ১০ ভাগ বেশি ভালোবাসি। মেয়েদের ১০০ ভাগ ও ছেলেকে ৯০ ভাগ ভালোবাসি।’

কখনো কি বাবা-মেয়ের মধ্যে অভিমান হয়েছে। এমন প্রশ্নের জবাবে মেয়ে শায়লা বলেন, ‘এটা ঠিক অভিমান না। তবে বাবা আমাদের কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাননি। কারণ, তিনি ভ্রমণে গেলে অসুস্থ হয়ে পড়তেন। ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা একটু ভিন্ন। চেম্বার থেকে শুরু করে সব জায়গায় বাবার সঙ্গে যেতাম। ওনার সঙ্গে মিশতাম। ওনার আইনজীবীর পোশাক থেকে শুরু করে সবকিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে। বাবার পোশাক ধরে রাখতেই আইন পেশায় এসেছি।’

আবদুল হাই বলেন, মান-অভিমান থাকা স্বাভাবিক। মাঝেমধ্যে কিছু হয়েছে। তবে ছেলের সঙ্গে অভিমান বেশি হয়েছে। ব্যস্ততার মধ্যেও মেয়েদের আগ্রহকে প্রাধান্য দিয়েছি। ছোট মেয়ে গান শিখত। সেটির খেয়াল রেখেছি। ছেলেমেয়ে নিয়ে শান্তিতে আছি। এটা আমার দুনিয়ার বেহেশত। আইনজীবী-পুলিশ সদস্যদের সন্তানেরা ভালো হয় না বলে অনেকেই বলে থাকে। কিন্তু আমার সন্তানেরা ভালো জায়গায় আছে। আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ। আর মেয়েরা আমাকে কোনো দিন বিরক্ত করেনি।

‘আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুর মতো’
বাবা সম্পর্কে লুৎফা ও শায়লা

লুৎফা ও শায়লা বলেন, ‘আমরা সবাই ব্যস্ত। তারপরও বাসায় ফিরে সবাই একসঙ্গে গল্প করি। ক্রিকেট খেলা উপভোগ করি। আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুর মতো।’

তিন মেয়ের মধ্যে কার সাফল্যে আপনি বেশি খুশি, এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল হাই বলেন, সাফল্য সাফল্যই। একে আলাদা করার সুযোগ নেই। প্রত্যেকে জনসেবামূলক পেশায় সম্পৃক্ত। চিকিৎসা ইবাদতের অংশ।

বাবা-মেয়ের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত প্রসঙ্গে লুৎফা বলেন, ‘বাবা হয়তো শাসন করে। সেটি আমাদের ভালোর জন্য। অনেক মেয়ে বাবাকে ভয় পায়। এই ভয়কে এড়িয়ে বাবাকে বন্ধু মনে করতে হবে। বাবার সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করলে সব সমাধান হয়ে যায়। বাবা বন্ধু হলে, দেখবেন বাবার চেয়ে পৃথিবীতে ভালো বন্ধু কেউ হতে পারবে না। তাই বাবার সঙ্গে মেয়ের সম্পর্কটা বন্ধুসুলভ হওয়া উচিত।’

বাবার কোন বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে, এমন প্রশ্নে দুই মেয়ের উত্তর, যখন কোথাও কেউ বলে তুমি আবদুল হাইয়ের মেয়ে। উনি অনেক ভালো ও সৎ মানুষ। এটি সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। বাবার এই আদর্শকে লালন করতে চাই।

এর আগে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শাহাদৎ হোসেন। সঞ্চালনা করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া বন্ধুসভার সভাপতি শাহজাহান মিয়া ও সাংগঠনিক সম্পাদক সবুজ আহমেদ। অনুষ্ঠান শেষে সবার অনুরোধে মেয়ে শায়লা একটি দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন।